আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন: কতটা সম্ভব, কতটা টেকসই?
আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন: কতটা সম্ভব, কতটা টেকসই?
বাংলাদেশে
আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন
অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা এবং এর টেকসইতা
নিয়ে প্রশ্নগুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং দেশের রাজনৈতিক
প্রেক্ষাপটে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। চলুন,
এই বিষয়গুলো বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
১.
আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে কি নির্বাচন সম্ভব?
তাত্ত্বিকভাবে
এবং আইনিভাবে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন
সম্ভব। যদি কোনো রাজনৈতিক
দল নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দল হিসেবে বিদ্যমান
থাকে এবং তাদের অংশগ্রহণ
করতে কোনো আইনি নিষেধাজ্ঞা
না থাকে, তাহলে তারা নির্বাচনে অংশ
নিতে পারবে।
তবে,
"আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে" বলতে
কী বোঝানো হচ্ছে, তার উপর নির্ভর
করে এই প্রশ্নের উত্তর
ভিন্ন হতে পারে:
- যদি
আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছায় নির্বাচন বর্জন করে: যেমনটি ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও তার মিত্ররা করেছিল, তখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এর অংশগ্রহণমূলকতা এবং গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সেই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন।
- যদি
আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে নিষিদ্ধ করা হয় বা অংশ নিতে না দেওয়া হয়: এটি একটি অত্যন্ত কঠিন এবং নজিরবিহীন পরিস্থিতি হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো প্রধান রাজনৈতিক দলকে (বিশেষ করে যে দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন এবং দেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব
দিয়েছে এবং যার
ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে) আইনিভাবে নিষিদ্ধ করা বা নির্বাচন থেকে বাদ দেওয়া হলে এর সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। এমন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন, সহিংসতা এবং আন্তর্জাতিক মহলের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
যাইহোক,
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের
মতো একটি মেরুকৃত রাজনীতিতে
যেখানে আওয়ামী লীগ একটি প্রধান
রাজনৈতিক শক্তি, সেখানে এই দলকে বাদ
দিয়ে একটি অর্থবহ ও
সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং।
২.
নির্বাচন হলেও তা কতটুকু টেকসই হবে?
আওয়ামী
লীগকে বাদ দিয়ে কোনো
নির্বাচন হলে তার টেকসইতা
নির্ভর করবে বেশ কয়েকটি
বিষয়ের উপর:
- গ্রহণযোগ্যতা
ও অংশগ্রহণ: যদি নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলগুলো (যেমন বিএনপি) এবং অন্যান্য ছোট দলগুলো অংশগ্রহণ করে এবং নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বলে বিবেচিত হয়, তাহলে সেই নির্বাচনের ফলাফল কিছুটা টেকসই হতে পারে। কিন্তু যদি অধিকাংশ প্রধান দল নির্বাচন বর্জন করে বা কারচুপির অভিযোগ ওঠে, তাহলে নির্বাচিত সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে এবং এর স্থায়িত্ব হুমকিতে পড়তে পারে।
- জনগণের
সমর্থন:
যদি জনগণের একটি বৃহৎ অংশ মনে করে যে নির্বাচনটি অবাধ ও নিরপেক্ষ ছিল না এবং তাদের ভোটাধিকার যথাযথভাবে প্রয়োগ হয়নি, তাহলে সরকার জনসমর্থন হারাতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
- আন্তর্জাতিক
স্বীকৃতি:
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বা একতরফা বলে মনে করে, তাহলে নির্বাচিত সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, যা অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
- বিরোধী
দলের আন্দোলন: যদি প্রধান রাজনৈতিক দল অনুপস্থিত থাকে বা নির্বাচন বর্জন করে, তবে তারা নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, যা দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে।
সাধারণত,
প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি
প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনই একটি সরকারের দীর্ঘমেয়াদী
টেকসইতার জন্য অপরিহার্য।
৩.
বিগত নির্বাচনগুলোর আলোকে কোন দলের ভোট কত শতাংশ?
বাংলাদেশের
বিগত কয়েকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের
শতাংশ এবং আসন সংখ্যার
দিকে নজর দিলে পরিস্থিতি
কিছুটা স্পষ্ট হবে:
নবম
জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০০৮: এটি তুলনামূলকভাবে অংশগ্রহণমূলক
এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছিল।
- বাংলাদেশ
আওয়ামী লীগ (মহাজোট): প্রায় ৪৮.০৪% ভোট পেয়েছিল এবং ২৩০টি আসনে জয়লাভ করেছিল।
- বাংলাদেশ
জাতীয়তাবাদী
দল (বিএনপি) (চারদলীয় জোট): প্রায় ৩৩.২০% ভোট পেয়েছিল এবং ৩০টি আসনে জয়লাভ করেছিল।
- জাতীয়
পার্টি (এরশাদ): প্রায় ৭.০৪% ভোট পেয়ে ২৭টি আসনে জয়লাভ করেছিল।
দশম
জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৪: এই নির্বাচন বিএনপি
ও তার জোট বয়কট
করেছিল। ১৫৩টি আসনে প্রার্থীরা বিনা
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
- বাংলাদেশ
আওয়ামী লীগ: নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, তবে ভোটার উপস্থিতি এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, যে ১৪৭টি আসনে ভোট হয়েছিল, সেখানে ভোটার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৪০%।
একাদশ
জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৮: এই নির্বাচনে বিএনপি
ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অংশগ্রহণ করলেও নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ছিল।
- বাংলাদেশ
আওয়ামী লীগ (মহাজোট): ৭৪.৬৩% ভোট পেয়েছিল (উইকিপিডিয়া তথ্য অনুযায়ী, যদিও মোট ভোটের ৭৬.৮৮% দাবি করা হয়েছিল) এবং ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করেছিল।
- বাংলাদেশ
জাতীয়তাবাদী
দল (জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট): ১৩.০৬% ভোট পেয়েছিল এবং মাত্র ৭টি আসনে জয়লাভ করেছিল।
- জাতীয়
পার্টি:
৫.২২% ভোট পেয়ে ২০টি আসনে জয়লাভ করেছিল।
দ্বাদশ
জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০২৪: এই নির্বাচনও বিএনপি
ও তার মিত্ররা বর্জন
করে। নির্বাচনটি মূলত আওয়ামী লীগ
এবং তাদের 'ডামি' বা স্বতন্ত্র প্রার্থীর
মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল।
- বাংলাদেশ
আওয়ামী লীগ: ২২২টি আসনে সরাসরি জয়লাভ করে (নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী)। মোট ভোটের শতাংশের সুনির্দিষ্ট তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি, তবে এই নির্বাচনকেও অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বলে মনে করা হয়নি। ভোটার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৪১.৮%।
উপসংহার:
বাংলাদেশের নির্বাচনগুলো, বিশেষ করে গত তিনটি,
রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং নির্বাচনকালীন সরকার
ব্যবস্থা নিয়ে চলমান বিতর্কের কারণে প্রায়শই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের একটি
প্রধান রাজনৈতিক শক্তি এবং এই দলকে
বাদ দিয়ে বা তাদের অনুপস্থিতিতে
একটি টেকসই, সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন
আয়োজন করা অত্যন্ত কঠিন।
একটি অর্থবহ গণতন্ত্রের জন্য প্রধান দলগুলোর
অংশগ্রহণ, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা এবং জনগণের আস্থার
পুনর্নির্মাণ অপরিহার্য।
প্রযুক্তি
বিষয়ক বিভিন্ন লেখা পড়তে ভিজিট
করুন: Tech News BD
ধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন লেখা পড়তে ভিজিট
করুন: The Divine Path
খেলাধূলা বিষয়ক বিভিন্ন লেখা পড়তে ভিজিট
করুন: Sports Bangladesh