মব সন্ত্রাস: ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে আইনের শাসনের সংকট
মব সন্ত্রাস: ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে আইনের শাসনের সংকট
সারসংক্ষেপ
বাংলাদেশে বর্তমানে চলমান মব সন্ত্রাসের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো যা বিশেষভাবে ৫
আগস্ট ২০২৪-এর রাজনৈতিক
পটপরিবর্তনের পর থেকে তীব্র
আকার ধারণ করেছে। এটি
কেবল বিচ্ছিন্ন অপরাধমূলক ঘটনা নয়, বরং
সুশাসন, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের
গভীর সংকটের একটি লক্ষণ।
এই সংকটের মূল
কারণগুলির মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা,
বিশেষ করে নিরাপত্তা ব্যবস্থার
শূন্যতা যা আনুষ্ঠানিক বিচারিক
প্রক্রিয়াকে অকার্যকর করে তুলেছে। ডিজিটাল
ভুল তথ্য এবং অ্যালগরিদমিক
প্রচারণার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা গুজব ও
উত্তেজনাকে দ্রুত ছড়িয়ে দিয়ে জনতাকে সহিংসতায় উস্কে দিচ্ছে। পাশাপাশি, বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের গভীর অনাস্থা এবং
বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই প্রবণতাকে আরও
বাড়িয়ে তুলছে।
মব সন্ত্রাসের প্রভাব সুদূরপ্রসারী, যার মধ্যে রয়েছে
ব্যাপক প্রাণহানি, শারীরিক আঘাত, এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু
ও রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীসহ দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর লক্ষ্যবস্তু হামলা।
এটি সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে, মানুষের
মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও ভীতি তৈরি
করছে এবং সামগ্রিকভাবে আইনের
শাসনকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায়
একটি সমন্বিত ও বহু-স্তরীয়
সংস্কারমূলক পদক্ষেপ অপরিহার্য। এর মধ্যে রয়েছে
আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা
জোরদার করা, নিরাপত্তা খাত
ও পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কার, বিচারিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সুশাসন প্রতিষ্ঠা, এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য
ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা
করা। পাশাপাশি, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও
এই সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করতে পারে।
এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ না করলে বাংলাদেশ
আরও গভীর অস্থিতিশীলতা ও
গণতান্ত্রায়নহীনতার দিকে ধাবিত হওয়ার
ঝুঁকিতে রয়েছে।
ভূমিকা: বাংলাদেশে মব সন্ত্রাসের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা
বাংলাদেশে গণসন্ত্রাস কেবল কিছু বিচ্ছিন্ন
অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নয়, বরং এটি
সুশাসন, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের
ক্ষেত্রে একটি গভীর সংকট
হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই ধরনের সহিংসতা
দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার
জন্য একটি গুরুতর হুমকি।
৫ আগস্ট ২০২৪
তারিখটি এই সমস্যাটির একটি
গুরুত্বপূর্ণ বাঁক হিসেবে চিহ্নিত
করা যায়। এই দিন থেকে বাংলাদেশে
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ডিজিটাল ভুল তথ্য এবং
স্বতঃস্ফূর্ত জনবিক্ষোভের এক বিপজ্জনক সংমিশ্রণ
দেখা গেছে, যা মব সন্ত্রাস এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের
এক মহামারিতে রূপ নিয়েছে। এই
সময়কাল থেকে, ডিজিটাল এবং শারীরিক উভয়
প্রকার জনতা শহুরে এলাকা,
গ্রামীণ এলাকা এবং এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
জুড়ে আনুষ্ঠানিক বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিস্থাপন করতে শুরু করেছে।
এই ঘটনাপ্রবাহকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য একটি লক্ষণীয়
এবং কাঠামোগত হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা
গভীর তদন্তের দাবি রাখে।
এই লেখাটি মাধ্যমে বাংলাদেশের
বর্তমান মব সন্ত্রাসের ব্যাপকতা তুলে ধরা হয়েছে। এতে মব সন্ত্রাসের বৈশিষ্ট্য, এর মূল কারণসমূহ,
পরিসংখ্যানগত প্রবণতা, শিকার এবং সমাজের উপর
এর গুরুতর প্রভাব, বিদ্যমান আইনি কাঠামো ও
সরকারি প্রতিক্রিয়া এবং সবশেষে, এই
ক্রমবর্ধমান সংকট মোকাবিলায় প্রস্তাবিত
বহু-স্তরীয় সমাধানসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা হয়েছে।
গণসন্ত্রাসের বৈশিষ্ট্য ও প্রকাশভঙ্গি
'মব সন্ত্রাসের সংজ্ঞা ও এর ভয়াবহতা
বাংলাদেশে 'মব সন্ত্রাস' (Mob Lynching) শব্দটি ব্যাপকভাবে পরিচিত, যার আভিধানিক অর্থ
"গণপ্রহার" বা "গণধোলাই"। তবে, বাংলাদেশ
ও ভারতের "সামাজিক বাস্তবতা"য় 'লিঞ্চিং' কেবল
মারধরকেই বোঝায় না। এটি উত্তেজিত
জনতা কর্তৃক কোনো একক বা
একদল ব্যক্তিকে পেটানো, কোপানো, এমনকি আগুনে পুড়িয়ে ফেলার মতো নৃশংস কর্মকাণ্ডকেও
বোঝায়। এই সংজ্ঞাগত বিস্তৃতি
গণসন্ত্রাসের চরম নৃশংসতা এবং
মানবিক অবক্ষয়ের একটি গভীর চিত্র
তুলে ধরে। এটি নির্দেশ
করে যে, প্রচলিত 'গণবিচার'
কেবল স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং এটি
এক ধরনের প্রাণঘাতী সম্মিলিত শাস্তি যা সমাজে মৌলিক
মানবিক সম্মান এবং আইনি সীমানার
গুরুতর লঙ্ঘনকে প্রতিফলিত করে। এই ধরনের
কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতি চরম অনাস্থা এবং
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার
প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
গণসন্ত্রাসের বিভিন্ন রূপ
গণসন্ত্রাস বাংলাদেশে বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হচ্ছে,
যা এর জটিলতা ও
বহুমুখী চরিত্রকে তুলে ধরে:
- গণবিচার
ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড: একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা হলো, জনতা নিজেদের হাতে আইন তুলে নিয়ে অভিযুক্তদের "বিচার" করছে এবং পিটুনি, লিঞ্চিং ও জোরপূর্বক স্বীকারোক্তির মাধ্যমে "শাস্তি" কার্যকর করছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ড প্রায়শই ডিজিটাল গুজব দ্বারা উৎসাহিত হয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার সুযোগে ঘটে থাকে 1।
- রাজনৈতিক
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত
লিঞ্চিং:
৫ আগস্ট ২০২৪-এর পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত লিঞ্চিংয়ের ঘটনায় নাটকীয় বৃদ্ধি দেখা গেছে। আগস্ট ২০২৪ থেকে মার্চ ২০২৫-এর মধ্যে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ৭৫ শতাংশেরও বেশি ঘটনার লক্ষ্যবস্তু ছিল প্রাক্তন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর সদস্য, যার মধ্যে প্রাক্তন ছাত্রনেতা এবং স্থানীয় কর্মকর্তারাও অন্তর্ভুক্ত 3। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শামীম মোল্লা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আব্দুল ওয়াহাব আল মাসুদ-এর মতো প্রাক্তন ছাত্রনেতাদের মর্মান্তিক মৃত্যু এই ধরনের সহিংসতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পূর্বে গণসহিংসতার প্রধান কারণ ছিল চুরি, ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের সন্দেহ; তবে ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত ঘটনার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে 3। গণসহিংসতার এই পরিবর্তন কেবল ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি নয়, বরং এর চরিত্র ও লক্ষ্যবস্তুর মৌলিক রূপান্তরকে নির্দেশ করে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, জনগণের অন্তর্নিহিত ক্ষোভকে রাজনৈতিক প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা স্বতঃস্ফূর্ত কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে আরও সংগঠিত বা নির্দেশিত সহিংসতার দিকে ইঙ্গিত করে। এই প্রবণতা রাষ্ট্রীয় অবহেলা বা জড়িত থাকার সম্ভাবনাকেও তুলে ধরে 1।
- অপরাধ-কেন্দ্রিক প্রতিশোধ: চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, চোরাচালান এবং মাদক ব্যবসা-সহ বিভিন্ন অপরাধের সন্দেহের ভিত্তিতে প্রায়শই প্রাণঘাতী গণসহিংসতা সংঘটিত হয়। ঢাকায় একজন উবার চালক রিয়াদকে ছিনতাইকারী সন্দেহে মিথ্যা অভিযোগে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা এই ধরনের সহিংসতার একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
- সাম্প্রদায়িক
উগ্রতা:
সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা প্রায়শই ধর্মীয় অবমাননার গুজব বা ভূমি বিরোধের কারণে ঘটে থাকে। ২০২১ সালের অক্টোবরে কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কোরআন অবমাননার গুজবের পর সংঘটিত "রক্তাক্ত শারদ" ঘটনাপ্রবাহ এর একটি উদাহরণ। এছাড়াও, ৫ আগস্ট ২০২৪-এর অব্যবহিত পরে ৫২টি জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়, যার ফলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংখ্যালঘু পরিবার ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
- অন্যান্য
উদ্দেশ্য:
কম সাধারণ হলেও, ছোটখাটো বিবাদ বা ব্যক্তিগত বিদ্বেষের কারণেও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। যেমন, নরসিংদীতে দুই ভাই একটি ছোট অটোরিকশা ভাড়ার বিরোধের জেরে জনতার হাতে নিহত হন, অথবা শরীয়তপুরে একজন ব্যক্তি প্রকাশ্যে ধূমপান বন্ধ করতে বলার কারণে পিটিয়ে নিহত হন।
- দুর্বল
লক্ষ্যবস্তু:
গণসহিংসতায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু, রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী, যুব উপসংস্কৃতি এবং বিশেষ করে, আগস্ট ২০২৪-এর পরবর্তী সময়ে প্রাক্তন ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর মতো নির্দিষ্ট দুর্বল গোষ্ঠীগুলো অসামঞ্জস্যিকভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে 1।
মূল কারণ ও উস্কানিমূলক উপাদান
বাংলাদেশে গণসন্ত্রাসের উত্থান একটি জটিল ও
বহুবিধ সংকটের ফল, যা রাজনৈতিক
অস্থিতিশীলতা, ডিজিটাল ভুল তথ্য এবং
প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার এক বিপজ্জনক সংমিশ্রণ।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক পতন
- কর্তৃত্বের
শূন্যতা:
৫ আগস্ট ২০২৪-এ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর যে ব্যাপক রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে, তার ফলে স্থানীয় প্রশাসনের বিলুপ্তি বা অকার্যকরতা দেশজুড়ে একটি উল্লেখযোগ্য নেতৃত্ব শূন্যতা এবং গভীর নিরাপত্তা শূন্যতা তৈরি করে। এই শূন্যতা জনতাকে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ করে দেয়।
- আইনের
শাসনের অবক্ষয় ও জনআস্থার অভাব: কয়েক দশকের রাজনৈতিকীকরণ করা পুলিশি ব্যবস্থা এবং বিচারিক নিষ্ক্রিয়তা আনুষ্ঠানিক শাসন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের বিশ্বাসকে মারাত্মকভাবে ক্ষয় করেছে। মানবাধিকারে সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (MSF) একটি ২০২৪ সালের সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের ৭২% মানুষ পুলিশের দ্রুত অপরাধ দমনে অক্ষমতার কারণে তাদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছে 1। এই ব্যাপক হতাশা সম্প্রদায়গুলোকে বিচারবহির্ভূত পদ্ধতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে জনতার শক্তি, জনরোষে পরিচালিত বিচার এবং "জনগণের আদালত" 1। পুলিশের প্রতি উচ্চ মাত্রার জনঅনাস্থা (২০২৪ সালে ৭২%) এবং গণসহিংসতার ঘটনায় অত্যন্ত কম দণ্ডপ্রাপ্তির হার (২০২৪ সালে ১৫%) বিচারহীনতার একটি গভীর চক্র তৈরি করে। যখন আনুষ্ঠানিক বিচারিক প্রক্রিয়াগুলো অকার্যকর, পক্ষপাতদুষ্ট বা অপ্রাপ্য বলে বিবেচিত হয়, তখন জনগণ সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের হাতে আইন তুলে নিতে উৎসাহিত হয়, যা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈধতাকে আরও ক্ষয় করে এবং গণসহিংসতাকে একটি বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
- দুর্বল
প্রয়োগ ও বিচারহীনতা: আইনি আদেশ এবং প্রকৃত প্রয়োগের মধ্যে একটি পদ্ধতিগত ব্যর্থতা বিদ্যমান। ২০২৪ সালে গণসহিংসতার মাত্র ১৫% ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছে, যেখানে মামলা খারিজ এবং দীর্ঘসূত্রিতা ছিল সাধারণ ব্যাপার। প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, রাজনৈতিক ব্যক্তিরা দলীয় সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার না করার নির্দেশ দিতে পারেন, যা কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়াই প্রতীকী প্রতিবাদকে উৎসাহিত করে এবং সহিংসতাকে স্বাভাবিক করে তোলে।
ডিজিটাল ভুল তথ্য ও অ্যালগরিদম দ্বারা প্রচার
- অ্যালগরিদম
দ্বারা সৃষ্ট প্রভাব: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলো, বিশেষ করে ফেসবুক, টিকটক এবং হোয়াটসঅ্যাপ, সাম্প্রদায়িক ও নৈতিক আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য শক্তিশালী অ্যালগরিদম দ্বারা প্রভাবিত। এদের কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যা রাগ, গুজব এবং চাঞ্চল্যকর তথ্যকে পুরস্কৃত করে, যার ফলে এমন ইকো চেম্বার তৈরি হয় যা যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই সম্মিলিত শাস্তিকে উস্কে দেয় 1।
- "ডিজিটাল
ওয়ারেন্ট"
এবং দ্রুত বিস্তার: হ্যাশট্যাগ এবং ক্লিকবেট কন্টেন্ট "ডিজিটাল ওয়ারেন্ট" হিসেবে কাজ করে, যা ভার্চুয়াল জনতাকে দ্রুত একত্রিত করে এবং সহিংস শারীরিক জনতায় রূপান্তরিত করে। ডিজিটাল নৃতাত্ত্বিক গবেষণা দেখায় যে, একটি গুজব ছড়িয়ে পড়া এবং ঘটনাস্থলে সহিংসতা শুরু হওয়ার মধ্যে সময়ের ব্যবধান প্রায় নেই বললেই চলে 1। অনলাইন গুজব ছড়িয়ে পড়া এবং অফলাইন সহিংসতা শুরু হওয়ার মধ্যে এই প্রায় অস্তিত্বহীন সময় ব্যবধান গণসহিংসতার গতি ও মাত্রায় একটি মৌলিক পরিবর্তন এনেছে। এর অর্থ হলো, ঐতিহ্যবাহী, প্রতিক্রিয়াশীল আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রতিক্রিয়া প্রায়শই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে, কারণ কর্তৃপক্ষ কার্যকরভাবে হস্তক্ষেপ করার আগেই জনতা গঠিত হয় এবং কাজ করে ফেলে। এটি দ্রুত প্রতিক্রিয়া প্রক্রিয়া এবং শক্তিশালী কন্টেন্ট মডারেশনের মতো সক্রিয় ডিজিটাল নজরদারির জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে।
- কন্টেন্ট
মডারেশনের অভাব: একটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতা হলো প্রধান বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মগুলোতে কার্যকর বাংলা ভাষার কন্টেন্ট মডারেশনের অভাব, যা উস্কানিমূলক গুজবগুলোকে অবাধে ছড়িয়ে পড়তে এবং ভাইরাল হতে দেয় 1।
- অনলাইন
থেকে অফলাইন ধারাবাহিকতা: গবেষণা অনলাইন গুজব থেকে অফলাইন সহিংসতা, অ্যালগরিদমিক দৃশ্যমানতা থেকে লক্ষ্যবস্তু হত্যাকাণ্ড এবং ডিজিটাল অপমান থেকে সম্প্রদায়িক আতঙ্কের এক তাৎপর্যপূর্ণ এবং বিপজ্জনক ধারাবাহিকতাকে চিহ্নিত করে। হাজারী লেনের গণপিটুনি এবং আগস্ট ২০২৪-পরবর্তী চট্টগ্রাম ক্যাম্পাসের দাঙ্গার মতো ঘটনাগুলো ডিজিটাল আতঙ্ক কীভাবে প্রাণঘাতী বাস্তব-বিশ্বের পরিণতিতে রূপান্তরিত হয় সে সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেয় 1। চট্টগ্রামে একটি ভুয়া লাউডস্পিকার ঘোষণার মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে শিশু অপহরণের মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা এবং তার ফলে গণপিটুনিতে হত্যা এর একটি সরাসরি উদাহরণ।
গণসহিংসতার পরিসংখ্যান ও প্রবণতা
বাংলাদেশে গণসহিংসতার ঘটনা ও হতাহতের
সংখ্যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে ৫ আগস্ট
২০২৪-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের
পর থেকে।
সারণী: বাংলাদেশে গণসহিংসতার ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা (২০১৫-২০২৫)
বছর |
ঘটনার
সংখ্যা (এইচআরএসএস/ এমএসএফ) |
নিহত
(এইচআরএসএস/ এমএসএফ) |
আহত
(এইচআরএসএস/ এমএসএফ) |
২০১৫-২০২৪ (মোট) |
১,০০৯ |
৭৯২ |
৭৬৫ |
২০২২ |
৭৯ |
৩৮ |
৮৩ |
২০২৩ |
১১৪ |
৭৩ |
৯১ |
২০২৪ |
২০১ |
১৭৯ |
৮৮ |
আগস্ট ২০২৪ (একক মাস) |
২০ |
২০ |
৪ |
সেপ্টেম্বর ২০২৪ (একক মাস) |
৩৬ |
২৮ |
১৪ |
আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০২৪ (মোট) |
- |
৪৯ |
- |
আগস্ট ২০২৪ - মার্চ ২০২৫ (৭ মাস) |
১১৪ |
১১৯ |
৭৪ |
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০২৫ (২ মাস) |
৩০ |
১৯ |
২০ |
মার্চ ২০২৫ (একক মাস) |
৩৯ |
১৩ |
৫৬ |
মে ২০২৫ (একক
মাস) |
২৬ |
১০ |
২৫ |
মে ২০২৫ (সঞ্চয়ী) |
- |
১৪৩ |
- |
দ্রষ্টব্য: বিভিন্ন উৎসের তথ্যে সামান্য ভিন্নতা থাকতে পারে। এখানে এইচআরএসএস এবং এমএসএফ-এর তথ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
- সাম্প্রতিক
বৃদ্ধি (৫ আগস্ট ২০২৪-এর পর):
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর, অর্থাৎ আগস্ট
২০২৪ থেকে, গণসহিংসতার ঘটনায় নাটকীয় বৃদ্ধি দেখা গেছে। মাত্র
সাত মাসের মধ্যে, অন্তত ১১৪টি গণপিটুনির ঘটনা রেকর্ড করা
হয়েছে, যার ফলে ১১৯
জন নিহত এবং ৭৪
জন আহত হয়েছেন। গণসহিংসতার
তীব্রতা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে; ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ ২০২৫-এর মধ্যে গণপিটুনির
ঘটনা ১৮টি থেকে বেড়ে
৩৯টিতে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে নিহতের
সংখ্যা ৮ থেকে বেড়ে
১৩তে উন্নীত হয়েছে। সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ হিউম্যান
রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (HRSS) ৩৬টি ঘটনায় অন্তত
২৮ জন নিহত ও
১৪ জন আহতের খবর
দিয়েছে। মে ২০২৫ নাগাদ,
গণসহিংসতায় নিহতের সংখ্যা ১৪৩-এ পৌঁছেছে
। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের
ঠিক পরেই গণসহিংসতার ঘটনা
এবং প্রাণহানির সংখ্যায় যে তাৎক্ষণিক ও
তীব্র বৃদ্ধি দেখা গেছে, তা
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার
শূন্যতার সঙ্গে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক
স্থাপন করে। এর মাধ্যমে
বোঝা যায় যে, রাজনৈতিক
পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক
হিসেবে কাজ করেছে, যা
গণপিটুনি ও লক্ষ্যবস্তু সহিংসতার
বৃদ্ধির জন্য একটি অনুকূল
পরিবেশ তৈরি করেছে।
- বার্ষিক
ও দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতা:
২০২৪ সালকে গত
দশকে গণসহিংসতার জন্য সবচেয়ে মারাত্মক
বছর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে
অন্তত ২০১টি ঘটনা রেকর্ড করা
হয়েছে, যার ফলে ১৭৯
জন নিহত এবং ৮৮
জন আহত হয়েছেন। এই
সংখ্যা ২০২৩ সালের নিহতের
সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি। ২০২৩ সালে ১১৪টি
ঘটনায় ৭৩ জন নিহত
ও ৯১ জন আহত
হয়েছিলেন। এইচআরএসএস-এর তথ্য অনুযায়ী,
২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল
পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ১,০০৯টি
গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যার
ফলে ৭৯২ জন নিহত
এবং ৭৬৫ জন আহত
হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার উল্লেখ করেছে যে, দেশজুড়ে ব্যাপক
অপ্রকাশিত ঘটনার কারণে গণসহিংসতার প্রকৃত সংখ্যা ও হতাহতের সংখ্যা
আরও বেশি হতে পারে।
- ভৌগোলিক
বিস্তার ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা:
গণসহিংসতার ঘটনা দেশের বগুড়া,
মাদারীপুর, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী, রাজশাহী এবং বরিশালের মতো
প্রধান অঞ্চলসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। উল্লেখযোগ্য মর্মান্তিক ঘটনাগুলির মধ্যে রয়েছে রিয়াদ (একজন উবার চালক),
নরসিংদীর দুই ভাই, শামীম
মোল্লা (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা), তোফাজ্জল হোসেন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে) এবং
আব্দুল ওয়াহাব আল মাসুদ (রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা)-এর মতো ব্যক্তিদের
গণপিটুনিতে মৃত্যু।
মনস্তাত্ত্বিক ও আদর্শিক দিক
- ব্যক্তিত্বহীনতা:
শারীরিক ও ভার্চুয়াল উভয় ক্ষেত্রেই বড় দলীয় পরিবেশে নাম প্রকাশ না করার সুযোগ ব্যক্তির আত্মসচেতনতা এবং নৈতিক জবাবদিহিতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়, যা ব্যক্তিদেরকে জনতার আবেগীয় গতিতে নৃশংস কাজ করতে সক্ষম করে তোলে।
- নিশ্চিতকরণ
পক্ষপাত:
অংশগ্রহণকারীরা একটি শক্তিশালী নিশ্চিতকরণ পক্ষপাত প্রদর্শন করে, যেখানে তারা তাদের বিদ্যমান বিশ্বাস এবং কুসংস্কারকে সমর্থন করে এমন তথ্য সক্রিয়ভাবে খুঁজে বের করে এবং ব্যাখ্যা করে, যার ফলে জনতার সম্মিলিত কর্মকাণ্ড ও বর্ণনা আরও শক্তিশালী হয়।
- ধর্ম
বা জাতিসত্তার প্রতি হুমকির ধারণা এবং বিচারহীনতার রোমান্টিকীকরণ: ধর্ম বা জাতিসত্তার প্রতি অনুভূত অস্তিত্বের হুমকি, জনপ্রিয় আলোচনায় বিচারহীনতার রোমান্টিকীকরণের সাথে মিলিত হয়ে, জনতা অংশগ্রহণের একটি শক্তিশালী আদর্শিক মাত্রা হিসেবে কাজ করে। উল্লেখযোগ্যভাবে, অপরাধীরা প্রায়শই কোনো অপরাধবোধ অনুভব করে না, বরং তারা বিশ্বাস করে যে তাদের সহিংস কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা সমাজ, রাষ্ট্র বা ধর্মকে সেবা করছে। গণসহিংসতায় অংশগ্রহণকারীরা প্রায়শই অপরাধবোধ অনুভব করে না এবং আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে যে তারা সমাজ, রাষ্ট্র বা ধর্মকে সেবা করছে। এই পর্যবেক্ষণটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, কেবল আইনি শাস্তির উপর ভিত্তি করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা যথেষ্ট নাও হতে পারে, কারণ অপরাধীরা একটি অনুভূত নৈতিক বা আদর্শিক ন্যায্যতা নিয়ে কাজ করে। সুতরাং, কার্যকর পাল্টা ব্যবস্থার মধ্যে বিচারহীনতার একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক অবমূল্যায়ন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যা এই ধরনের সহিংসতাকে রোমান্টিকীকরণ বা ন্যায্যতা প্রদানকারী বর্ণনাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করবে।
- নৈতিক
আতঙ্ক ও বলির পাঁঠা বানানো: প্রান্তিক গোষ্ঠী বা ব্যক্তিদের প্রতি সম্মিলিত শত্রুতার দ্রুত বৃদ্ধি, যা প্রায়শই অতিরঞ্জিত গুজব বা মিথ্যা অভিযোগ দ্বারা উৎসাহিত হয়, "ফোক ডেভিলস" তৈরি করে যারা বৃহত্তর সামাজিক উদ্বেগ এবং হতাশার জন্য সুবিধাজনক বলির পাঁঠা হিসেবে কাজ করে 1।
- ঐতিহাসিক
উত্তরাধিকার:
বাংলাদেশে বিচারহীনতার একটি ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার রয়েছে, যেখানে গ্রামীণ বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা যেমন 'সালিশ' (গ্রাম পরিষদ) দীর্ঘদিন ধরে বিচারবহির্ভূত শাস্তিকে অনুমোদন দিয়েছে। শহরায়ন এই ঐতিহ্যবাহী অনুশীলনগুলোকে আধুনিক রাজনৈতিক সহিংসতার সাথে মিশিয়ে দিয়েছে, যা সমাজে এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে আরও স্বাভাবিক করে তুলেছে 3।
- সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণ: খুলনা ও সাতক্ষীরার মতো দুর্বল অঞ্চলে অর্থনৈতিক হতাশা, ব্যাপক দারিদ্র্য এবং উচ্চ বেকারত্বের হার হতাশা-প্রবণ অপরাধকে বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং গণসহিংসতায় অংশগ্রহণ ও নিয়োগে অবদান রাখতে পারে 3।
শিকার, সমাজ ও বিচার ব্যবস্থার উপর প্রভাব
গণসহিংসতার প্রভাব শিকার, সমাজ এবং বিচার
ব্যবস্থার উপর গুরুতর এবং
বহুমুখী।
মানবিক প্রভাব
- প্রাণহানি
ও আঘাত: সবচেয়ে প্রত্যক্ষ ও মর্মান্তিক প্রভাব হলো উল্লেখযোগ্য প্রাণহানি এবং গুরুতর আঘাত। আগস্ট ২০২৪ থেকে মার্চ ২০২৫-এর মধ্যে, বিচারহীন হামলা ১১৯ জনের জীবন কেড়ে নিয়েছে এবং ৭৪ জনকে আহত করেছে। ২০২৪ সাল একাই গণসহিংসতার কারণে ১৭৯ জনের মৃত্যুর রেকর্ড করেছে, যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ বার্ষিক সংখ্যা।
- লক্ষ্যবস্তু
হামলা:
গণসহিংসতা নির্দিষ্ট দুর্বল গোষ্ঠীগুলোকে অসামঞ্জস্যিকভাবে লক্ষ্যবস্তু করে, যার মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী, যুব উপসংস্কৃতি এবং, আগস্ট ২০২৪-পরবর্তী সময়ে, প্রাক্তন ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনগুলো।
- মিথ্যা
অভিযোগ:
একটি বিশেষ বিপজ্জনক প্রভাব হলো মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে নিরীহ ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করা, যা মর্মান্তিক ও অন্যায় পরিণতির দিকে নিয়ে যায়, যেমনটি উবার চালক রিয়াদকে মিথ্যা ছিনতাইয়ের অভিযোগে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দেখা গেছে।
- স্থানচ্যুতি
ও হয়রানি: সাম্প্রদায়িক উগ্রতা হাসিনা-পরবর্তী সময়ে অনেক সংখ্যালঘু পরিবারকে স্থানচ্যুত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে, যেখানে হামলাগুলো প্রায়শই রাজনৈতিক প্রতিহিংসাকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সাথে মিশিয়ে দেয়। আগস্ট ২০২৪-এর অব্যবহিত পরে হাজার হাজার বাংলাদেশি, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা, বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করে।
সামাজিক প্রভাব
- প্রাতিষ্ঠানিক
আস্থার অবক্ষয়: কয়েক দশকের রাজনৈতিকীকরণ করা পুলিশি ব্যবস্থা এবং বিচারিক নিষ্ক্রিয়তা আনুষ্ঠানিক শাসন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের বিশ্বাসকে মারাত্মকভাবে ক্ষয় করেছে। ২০২৪ সালের এমএসএফ সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ৭২% বাংলাদেশি পুলিশের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছে, যা সম্প্রদায়গুলোকে বিচারবহির্ভূত পদ্ধতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
- নিরাপত্তা
শূন্যতা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতা: আগস্ট ২০২৪-এর অভ্যুত্থান আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনেক অবকাঠামো ভেঙে দিয়েছে। হাসিনা-পরবর্তী সময়ে, ৩০% পুলিশ পদ শূন্য হয়ে পড়ে এবং ৬৩৯টি পুলিশ স্টেশনের মধ্যে ৪৫০টি হামলার পর অকার্যকর হয়ে যায়। পুলিশের রাস্তা থেকে সরে যাওয়া, প্রতিশোধের ভয়ে, জনতাকে অবাধে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে।
- অন্যান্য
অপরাধের বৃদ্ধি: বিরাজমান নিরাপত্তা শূন্যতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় অন্যান্য অপরাধের ব্যাপক বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে; উদাহরণস্বরূপ, জানুয়ারি ২০২৫-এ ঢাকায় ডাকাতির ঘটনা ৬৯% বৃদ্ধি পেয়েছে 3। গণসহিংসতার নাটকীয় বৃদ্ধি এবং সাধারণ অপরাধের (যেমন, ঢাকায় ডাকাতির ঘটনা ৬৯% বৃদ্ধি) যুগপৎ বৃদ্ধি কেবল বিচারিক পদ্ধতির পরিবর্তন নয়, বরং সামাজিক শৃঙ্খলার একটি ব্যাপক, পদ্ধতিগত ভাঙ্গনকে নির্দেশ করে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় এবং নিরাপত্তা শূন্যতা সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে, যেখানে গণসহিংসতা এই গভীর সামাজিক অসুস্থতার একটি বিশেষ নৃশংস ও দৃশ্যমান প্রকাশ।
- বিচারহীনতার
স্বাভাবিকীকরণ:
বিচারহীনতার ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার, যেমন গ্রামীণ বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা 'সালিশ' যা দীর্ঘদিন ধরে বিচারবহির্ভূত শাস্তিকে অনুমোদন দিয়েছে, শহুরে এলাকায় আধুনিক রাজনৈতিক সহিংসতার সাথে মিশে গেছে, যা সমাজে বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে আরও স্বাভাবিক করে তুলেছে 3।
বিচারিক প্রভাব ও বিচারহীনতা
- কম
দণ্ডপ্রাপ্তির
হার: গণসহিংসতার অপরাধীদের কার্যকরভাবে বিচার করতে বিচার ব্যবস্থার ব্যর্থতা কম দণ্ডপ্রাপ্তির হারে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান; ২০২৪ সালে গণসহিংসতার মাত্র ১৫% ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছে।
- বিচারহীনতার
সংস্কৃতি:
প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন করতে, অপরাধীদের বিচার করতে এবং পদ্ধতিগত বৈষম্য মোকাবিলায় এই ধারাবাহিক ব্যর্থতা বিচারহীনতার একটি গভীর সংস্কৃতিকে স্থায়ী করার ঝুঁকি তৈরি করে, যা ফলস্বরূপ গণসহিংসতার কারণে আরও বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটায় এবং সহিংসতার চক্রকে স্থায়ী করে।
- বিলম্বিত
বিচার:
তদন্তের দুর্বলতা, প্রায়শই সাক্ষী সুরক্ষার অভাব দ্বারা জটিল, মামলাগুলোকে আদালতে আনতে উল্লেখযোগ্য বিলম্ব ঘটায়, যার ফলে শিকার এবং তাদের পরিবারকে সময়মতো বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
বিদ্যমান আইনি কাঠামো ও সরকারি প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশে গণসহিংসতা মোকাবিলায় কিছু আইনি কাঠামো
এবং সরকারি পদক্ষেপ বিদ্যমান রয়েছে, তবে সেগুলোর বাস্তবায়নে
চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
সাংবিধানিক ও আইনি বিধান
- জীবন
ও যথাযথ প্রক্রিয়ার অধিকার: বাংলাদেশের সংবিধান মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে, যার মধ্যে আইনের সামনে সমতা (অনুচ্ছেদ ২৭), জীবন ও স্বাধীনতার সুরক্ষা (অনুচ্ছেদ ৩১), আইনি পরামর্শ পাওয়ার অধিকার (অনুচ্ছেদ ৩৩) এবং দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ থাকার অনুমান (অনুচ্ছেদ ৩৫) অন্তর্ভুক্ত 4। এই বিধানগুলো গণবিচারের মূল ধারণার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
- ফৌজদারি
দণ্ডবিধির বিধান: গণসহিংসতাকে আইনগতভাবে সামাজিক অপরাধ এবং হত্যাকাণ্ড হিসেবে গণ্য করা হয়, যার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। দেশের দণ্ডবিধিতে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
- পুলিশের
কাছে হস্তান্তর বাধ্যতামূলক: ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী, গ্রেপ্তারকৃত অপরাধীকে অবিলম্বে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা বাধ্যতামূলক। এই আইনি বাধ্যবাধকতা পালনে ব্যর্থতা দণ্ডবিধির ১৮৭ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
- আক্রমণ
ও গুরুতর আঘাতের শাস্তি: দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারা (যেমন, ধারা ৩১৯, ৩২৩, ৩২৫, ৩৩৫) আক্রমণ এবং ইচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর আঘাতের জন্য কারাদণ্ড থেকে জরিমানা পর্যন্ত শাস্তির বিধান করে, যা গণসহিংসতার অবিচ্ছেদ্য অংশ ।
- আক্রমণের
ফলে মৃত্যু: যদি আক্রমণের ফলে কারো মৃত্যু হয়, দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারা অনুযায়ী দশ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানার বিধান রয়েছে। যদি প্রমাণিত হয় যে অপরাধীকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাহলে শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং জরিমানা পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
- যৌথ
দায়: গুরুত্বপূর্ণভাবে, দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা অনুযায়ী, যদি গণসহিংসতায় কোনো ব্যক্তি নিহত হয়, তাহলে গণসহিংসতায় অংশগ্রহণকারী সকল ব্যক্তি সমানভাবে দায়ী হবে, যা আইনের 'যৌথ দায়বদ্ধতা' নীতির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এর অর্থ হলো, যদি আদালতে গণপিটুনিতে হত্যা প্রমাণিত হয়, তাহলে জড়িত সকলের জন্য সর্বনিম্ন শাস্তি হবে 'যাবজ্জীবন কারাদণ্ড' (ধারা ৩০২ অনুযায়ী)। কঠোর আইনি কাঠামো, যার মধ্যে যৌথ দায়বদ্ধতা এবং সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রয়েছে (মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত), এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির মধ্যে একটি স্পষ্ট বৈপরীত্য বিদ্যমান, যা কম দণ্ডপ্রাপ্তির হার (২০২৪ সালে ১৫%) দ্বারা চিহ্নিত। এটি নির্দেশ করে যে, মূল সমস্যা আইনের ঘাটতি নয়, বরং সেগুলোর বাস্তবায়ন, তদন্ত এবং প্রয়োগে একটি মৌলিক ও পদ্ধতিগত ব্যর্থতা।
আদালতের নির্দেশনা
২০১৯ সালে তাসলিমা
বেগম রেনু হত্যাকাণ্ডের পর,
হাইকোর্ট গণসহিংসতা প্রতিরোধে পাঁচটি নির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করে। এর
মধ্যে রয়েছে পুলিশ সার্কেল অফিসার এবং থানার ভারপ্রাপ্ত
কর্মকর্তাদের মধ্যে গণসহিংসতার প্রবণতা নিয়ে নিয়মিত বৈঠক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক গণমাধ্যমে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা, গুজব ও উস্কানি
মোকাবিলায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পর্যবেক্ষণ, পুলিশের দ্বারা দ্রুত ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট (FIR) নিবন্ধন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের
দ্বারা অবহেলার তদন্ত।
সরকার ও পুলিশের বিবৃতি/পদক্ষেপ
- জিরো
টলারেন্স:
অন্তর্বর্তী সরকার, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমের মাধ্যমে, গণবিচারের মতো ঘটনার প্রতি "জিরো টলারেন্স" নীতি ঘোষণা করেছে, স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে এবং ব্যক্তিদের আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
- কঠোর
পর্যবেক্ষণ
ও পদক্ষেপ: পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), মোঃ মইনুল ইসলাম, নিশ্চিত করেছেন যে গণসহিংসতার ঘটনায় 'পরিকল্পিত হত্যা'র মামলা দায়ের করা হচ্ছে এবং সামগ্রিক ঘটনাগুলো কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, পাশাপাশি ইউনিট প্রধানদেরকে এই ধরনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
- জবাবদিহিতার
আশ্বাস:
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা, আসিফ নজরুল, দ্রুত পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়েছেন, বলেছেন যে গণবিচার, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া, গণসহিংসতা বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কোনো রূপই গ্রহণযোগ্য হবে না এবং সরকার আইনি উপায়ে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করবে।
বাস্তবায়ন ও প্রয়োগে চ্যালেঞ্জ
ব্যাপক আইন এবং সরকারের
ঘোষিত প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও, মানবাধিকার
কর্মীরা ক্রমাগত উল্লেখ করছেন যে প্রধান চ্যালেঞ্জ
হলো সেগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ। তদন্তের
দুর্বলতা, পাশাপাশি সকল অপরাধীকে বিচারের
আওতায় আনতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা
বা সক্ষমতার অভাব, প্রায়শই বিচারিক প্রক্রিয়ায় বিলম্ব ঘটায় এবং বিচারহীনতাকে স্থায়ী
করে।
প্রস্তাবিত সমাধান ও প্রতিরোধ কৌশল
বাংলাদেশে গণসন্ত্রাস মোকাবিলায় একটি ব্যাপক এবং
বহু-স্তরীয় সংস্কারমূলক পদক্ষেপ অপরিহার্য, যা কেবল আইন
প্রয়োগের উপর নির্ভরশীল না
হয়ে সামাজিক, ডিজিটাল এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রগুলোতেও
পরিবর্তন আনবে।
সারণী: গণসহিংসতা দমনে প্রস্তাবিত বহু-স্তরীয় সংস্কার
সংস্কারের
ক্ষেত্র |
প্রস্তাবিত
নির্দিষ্ট পদক্ষেপ/কৌশল |
সংক্ষিপ্ত
যুক্তি/প্রত্যাশিত ফলাফল |
আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা |
যথাযথ প্রক্রিয়া নিশ্চিতকরণ আইন প্রণয়ন (ফৌজদারি কার্যবিধির বিতর্কিত ধারা সংস্কার) |
জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের সুযোগ হ্রাস |
সংবিধানে অধিকার সনদ সুরক্ষা (বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতন থেকে সুরক্ষা) |
মৌলিক মানবাধিকারের সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ |
|
নৈতিক আতঙ্ক ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য
আইন (ভুয়া গুজব ও ডিজিটাল উস্কানি
দণ্ডনীয় করা) |
ভুল তথ্য ও উস্কানি ছড়ানো
প্রতিরোধ, বাকস্বাধীনতার সুরক্ষা |
|
সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রতিষ্ঠা (সাক্ষীদের পরিচয় গোপন রাখা, স্থানান্তরের বিধান) |
সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, সাক্ষ্য প্রদানে উৎসাহিত করা |
|
নিরাপত্তা খাত ও পুলিশ সংস্কার |
জনবল ঘাটতি পূরণ (পুলিশ বাহিনীতে ৩০% শূন্যপদ পূরণ) |
পুলিশের কার্যকারিতা ও উপস্থিতি বৃদ্ধি |
কর্মকর্তাদের পুনঃপ্রশিক্ষণ (উত্তেজনা প্রশমন, মানবাধিকার প্রশিক্ষণ) |
মানবিক ও পেশাদার পুলিশি
ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, জনআস্থা বৃদ্ধি |
|
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আক্রমণকারীদের বিচার (হামলাকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা) |
পুলিশের মনোবল পুনরুদ্ধার, আইন প্রয়োগের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা |
|
স্বাধীন নিরাপত্তা তদারকি (বেসামরিক তদারকি কমিশন গঠন) |
বিচারিক পর্যালোচনা, ক্ষমতার অপব্যবহারের তদন্ত, স্বচ্ছতা |
|
স্বচ্ছ, বেসামরিক-নেতৃত্বাধীন পুলিশিং (সামরিকীকৃত দমন-পীড়ন পরিহার) |
অতীতের স্বৈরাচারী অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি রোধ, জনবিশ্বাস অর্জন |
|
বিচারিক সক্ষমতা বৃদ্ধি |
গণসহিংসতা মামলার জন্য দ্রুত বিচার আদালত স্থাপন |
বিচার প্রক্রিয়ার দ্রুততা, দণ্ডপ্রাপ্তির হার বৃদ্ধি |
বিচারিক নিয়োগ সংস্কার (নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা) |
বিচারিক স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ |
|
আন্তর্জাতিক তদন্ত মান প্রয়োগ (হিংসাত্মক মৃত্যুর তদন্তে মিনেসোটা প্রোটোকল) |
ফরেনসিক অখণ্ডতা, প্রমাণের বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিতকরণ |
|
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সুশাসন ও মিডিয়া নীতি |
কন্টেন্ট মডারেশন জোরদার (বাংলা ভাষার বিদ্বেষমূলক বার্তা দ্রুত অপসারণ) |
গুজব ও উস্কানির বিস্তার
রোধ, "মব-ভাইরাল-জাস্টিস
লুপ" ব্যাহত করা |
ডিজিটাল সাক্ষরতা অভিযান সম্প্রসারণ (স্কুল পাঠ্যক্রম ও জনসচেতনতা) |
নাগরিকদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা ও গুজব যাচাইয়ে
সক্ষম করা |
|
বিদ্বেষমূলক বর্ণনা বিপরীতকরণ (স্থানীয় প্রভাবশালীদের মাধ্যমে পাল্টা বর্ণনা প্রচার) |
বিচারহীনতার রোমান্টিকীকরণকে চ্যালেঞ্জ করা, শান্তি প্রচার |
|
অন্তর্বর্তীকালীন
ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণ কাঠামো |
পাবলিক ট্রুথ কমিশন (আগস্ট ২০২৪-এর দমন-পীড়ন
ও গণহত্যা তদন্ত) |
বিশ্বাসযোগ্যতা
ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ, জবাবদিহিতা |
ক্ষতিগ্রস্তদের
ক্ষতিপূরণ (আর্থিক, আইনি, মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা) |
আন্তর্জাতিক ক্ষতিপূরণ নীতির আলোকে পূর্ণাঙ্গ প্রতিকার |
|
স্মৃতিচারণ উদ্যোগ (গণসহিংসতার ইতিহাস লিপিবদ্ধকরণ, প্রদর্শনী) |
সম্মিলিত সত্য ও নিরাময়ের দিকে
পদক্ষেপ |
|
দারিদ্র্যবিরোধী
ও সামাজিক বিনিয়োগ (প্রান্তিক অঞ্চলে কর্মসংস্থান ও সামাজিক সংহতি) |
হতাশা-প্রবণ অপরাধ হ্রাস, গণসহিংসতায় নিয়োগের সুযোগ কমানো |
|
সম্প্রদায়-নেতৃত্বাধীন উদ্যোগ ও জনসচেতনতা |
সংলাপ ও প্রচারাভিযান (রাজশাহীতে
এমএসএফ-এর পাইলট প্রকল্পের
সাফল্য) |
সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা, গণসহিংসতা হ্রাস |
ছাত্রনেতাদের একত্রিত করা (বিচারহীনতার নিন্দা ও আইনের শাসনের
প্রচার) |
নৈতিক কর্তৃত্ব ব্যবহার, শান্তিপূর্ণ আচরণ উৎসাহিত করা |
|
মানবাধিকার রক্ষকদের উত্থান (উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার জন্য হস্তক্ষেপ) |
সমাজে আইনি নীতি ও মানবিক মূল্যবোধের
পুনঃপ্রতিষ্ঠা |
|
আন্তর্জাতিক
সম্পৃক্ততা ও মানবাধিকার অংশীদারিত্ব |
জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ (জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক ও মানবাধিকার মিশন) |
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা |
বিদেশী শান্তিরক্ষী অন্তর্ভুক্তিতে বিধিনিষেধ (র্যাব, ডিজিএফআই-এর রেকর্ডযুক্ত সৈন্যদের
বাদ দেওয়া) |
বৈশ্বিক মানদণ্ডের সাথে সঙ্গতি, জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ |
|
আইসিসি-তে জবাবদিহিতা (আগস্ট
২০২৪-পরবর্তী মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ) |
জনআশা পূরণ, আইনি নজির স্থাপন |
|
দাতা সমন্বয় (পুলিশ, আদালত, ডিজিটাল সাক্ষরতা, নাগরিক সমাজ পুনর্গঠনে তহবিল) |
কার্যকর সংস্কার বাস্তবায়নে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা |
মনস্তাত্ত্বিক ও আদর্শিক দিক
গণসহিংসতায় অংশগ্রহণকারীরা প্রায়শই কোনো অপরাধবোধ অনুভব
করে না এবং আন্তরিকভাবে
বিশ্বাস করে যে তারা
সমাজ, রাষ্ট্র বা ধর্মকে সেবা
করছে। এই পর্যবেক্ষণটি অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। এটি ইঙ্গিত দেয়
যে, কেবল আইনি শাস্তির
উপর ভিত্তি করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা
যথেষ্ট নাও হতে পারে,
কারণ অপরাধীরা একটি অনুভূত নৈতিক
বা আদর্শিক ন্যায্যতা নিয়ে কাজ করে। সুতরাং,
কার্যকর পাল্টা ব্যবস্থার মধ্যে বিচারহীনতার একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক
ও আদর্শিক অবমূল্যায়ন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যা
এই ধরনের সহিংসতাকে রোমান্টিকীকরণ বা ন্যায্যতা প্রদানকারী
বর্ণনাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করবে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সুশাসন ও মিডিয়া নীতি
বাংলা ভাষার কন্টেন্ট মডারেশন জোরদার করা এবং ব্যাপক
ডিজিটাল সাক্ষরতা অভিযান বাস্তবায়নের উপর জোরালো গুরুত্ব
দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতিকে
নির্দেশ করে যে, ডিজিটাল
স্থান কেবল অফলাইন উত্তেজনার
একটি নিষ্ক্রিয় প্রতিফলন নয়, বরং গণসহিংসতার
একটি সক্রিয় চালিকাশক্তি ও ত্বরক। এর
অর্থ হলো, কার্যকর ও
আধুনিক সমাধানগুলির মধ্যে অবশ্যই একটি শক্তিশালী ডিজিটাল
উপাদান অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে, যা অনলাইন
ভুল তথ্য এবং উস্কানিকে
শারীরিক ক্ষতির প্রত্যক্ষ পূর্বসূরী হিসাবে বিবেচনা করবে এবং প্রতিক্রিয়াশীল
ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
উপসংহার: আইনের শাসন পুনরুদ্ধারের পথ
বাংলাদেশে গণসন্ত্রাসের মহামারি কেবল একটি আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা নয়, বরং এটি
সুশাসন, প্রাতিষ্ঠানিক আস্থা এবং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের
একটি গভীর, বহু-মাত্রিক সংকট।
এই সমস্যাটি সমাজের প্রতিটি স্তরে তার প্রভাব ফেলছে
এবং এর সমাধান কেবল
বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে সম্ভব নয়।
যদি আইনি, ডিজিটাল,
প্রাতিষ্ঠানিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে
স্পষ্ট, সিদ্ধান্তমূলক এবং সমন্বিত পরিবর্তন
আনা না হয়, তাহলে
বাংলাদেশ আরও গভীর গণতান্ত্রায়নহীনতা
এবং ব্যাপক আইনহীনতার দিকে ধাবিত হওয়ার
ঝুঁকিতে রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত নীতিকে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট, কার্যকর পদক্ষেপে রূপান্তরিত করতে হবে: রাষ্ট্রীয়
প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করা,
সকল অপরাধীকে দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে বিচারের
আওতায় আনা এবং পদ্ধতিগত
বৈষম্যগুলোকে সামগ্রিকভাবে মোকাবিলা করা।
যেমনটি অ্যাক্টিভিস্ট নূর খান লিটন
জোর দিয়ে বলেছেন, "আইনের শাসন ছাড়া কোনো
উপায় নেই"। এই সংকট
মোকাবিলায় ব্যর্থতা আরও প্রাণহানি, গভীর
সামাজিক বিভাজন এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির
অপরিবর্তনীয় স্থায়ীত্ব ঘটাতে পারে। সুতরাং, এই মুহূর্তে জবাবদিহিতা
নিশ্চিত করা এবং কার্যকর
পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।
Works cited
(PDF) Today, the Entire Bangladesh is Hostage to the Crowds: Mob ..., accessed June 23, 2025, https://www.researchgate.net/publication/392723213_Today_the_Entire_Bangladesh_is_Hostage_to_the_Crowds_Mob_Trials_Digital_Panic_and_the_Algorithmic_Collapse_of_Rule_of_Law_After_5_August_2024
গণপিটুনিতে হত্যার সঠিক তদন্ত ও বিচার হচ্ছে কি? - চ্যানেল আই অনলাইন, accessed June 23, 2025, https://www.channelionline.com/%E0%A6%97%E0%A6%A3%E0%A6%AA%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%B9%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A6%A0%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%A4/
Reasons Behind Rising Mob Violence | Mob violence: Causes ..., accessed June 23, 2025, https://www.thedailystar.net/opinion/views/news/mob-violence-causes-consequences-and-pathways-justice-3868831
গণপিটুনির বিষয়ে সংবিধান ও আইনে কী বলা আছে? - Jugantor, accessed June 23, 2025, https://www.jugantor.com/national/854691
Attacks on journos, mob violence surge in May - The Daily Star, accessed June 23, 2025, https://www.thedailystar.net/news/bangladesh/news/attacks-journos-mob-violence-surge-may-3909811
HRSS Report on Mob Killings Bangladesh | 119 killed by mobs in 7 ..., accessed June 23, 2025, https://www.thedailystar.net/news/bangladesh/crime-justice/news/119-killed-mobs-7-months-hrss-3840721
গণপিটুনির ঘটনা কেন ঘটছে? আইনে এর শাস্তি কী? - The Daily Ittefaq, accessed June 23, 2025, https://www.ittefaq.com.bd/700813/%E0%A6%97%E0%A6%A3%E0%A6%AA%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%98%E0%A6%9F%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%98%E0%A6%9F%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%87%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%8F%E0%A6%B0-%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A7%80
Rising Mob Violence In Bangladesh 2025 | Why can't mob violence ..., accessed June 23, 2025, https://www.thedailystar.net/opinion/editorial/news/why-cant-mob-violence-be-contained-3864941
অক্টোবর ২০২১-এ বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা - উইকিপিডিয়া, accessed June 23, 2025, https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%85%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A7%8B%E0%A6%AC%E0%A6%B0_%E0%A7%A8%E0%A7%A6%E0%A7%A8%E0%A7%A7-%E0%A6%8F_%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87_%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BF%E0%A6%95_%E0%A6%B8%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%82%E0%A6%B8%E0%A6%A4%E0%A6%BE
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা - উইকিপিডিয়া, accessed June 23, 2025, https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87_%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BF%E0%A6%95_%E0%A6%B8%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%82%E0%A6%B8%E0%A6%A4%E0%A6%BE
বাংলাদেশে উচ্ছৃঙ্খল গণবিচার - উইকিপিডিয়া, accessed June 23, 2025, https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87_%E0%A6%89%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A7%83%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%96%E0%A6%B2_%E0%A6%97%E0%A6%A3%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B0
১০ বছরে ১০০৯ গণপিটুনির ঘটনায় নিহত ৭৯২, আহত ৭৬৫: এইচআরএসএস | The Daily Star Bangla, accessed June 23, 2025, https://bangla.thedailystar.net/news/bangladesh/news-656206
দেশে গণপিটুনির ঘটনা বাড়ছে, ৭ মাসে নিহত ১১৯ জন - প্রথম আলো, accessed June 23, 2025, https://www.prothomalo.com/bangladesh/crime/1liduun6z5
গণপিটুনিতে এত মৃত্যু : দায় নেবে কে? - Protidiner Bangladesh, accessed June 23, 2025, https://protidinerbangladesh.com/feature/118677/%E0%A6%97%E0%A6%A3%E0%A6%AA%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%8F%E0%A6%A4-%E0%A6%AE%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%81-%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%87
দেশে বেড়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা, বাড়ছে গণপিটুনিও - Independent Television, accessed June 23, 2025, https://www.itvbd.com/national/210165/%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A7%9C%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%88%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%B8%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%82%E0%A6%B8%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%97%E0%A6%A3%E0%A6%AA%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%93
16. যেভাবে দেশ গণপিটুনিতে অভ্যস্ত হলো - প্রথম আলো, accessed June 23, 2025, https://www.prothomalo.com/opinion/column/%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6-%E0%A6%97%E0%A6%A3%E0%A6%AA%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BF%E0%A6%A4-%E0%A6%B9%E0%A6%B2%E0%A7%8B