মৌর্য সাম্রাজ্যের ইতিহাস: রাজনৈতিক বিবর্তন, প্রশাসনিক কাঠামো এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
১. ভূমিকা: প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের এক যুগান্তকারী সন্ধিক্ষণ। এই সময়েই প্রথমবারের মতো ভারতীয় রাজনীতির দিগন্ত ছোট ছোট ‘জনপদ’ ও ‘মহাজনপদ’-এর গণ্ডি পেরিয়ে এক অখণ্ড সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যের রূপ লাভ করে। মগধকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মৌর্য সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ – ১৮৫) কেবল ভৌগোলিক বিস্তৃতির দিক থেকেই বিশাল ছিল না, বরং এর প্রশাসনিক দক্ষতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা প্রাচীন বিশ্বকে বিস্মিত করেছিল। পশ্চিমে আফগানিস্তানের হিন্দু কুশ পর্বতমালা থেকে পূর্বে বঙ্গোপসাগর এবং উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যের মহীশূর পর্যন্ত বিস্তৃত এই সাম্রাজ্য ছিল লৌহ যুগের ভারতের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার এক চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ 1।
এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য হলো মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থান, বিকাশ এবং পতনের একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ও বিশ্লেষণাত্মক ইতিহাস উপস্থাপন করা। আমরা কেবল রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনায় সীমাবদ্ধ থাকব না, বরং কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’, মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা’ এবং অশোকের শিলালিপিগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তৎকালীন প্রশাসন, সমাজ, অর্থনীতি এবং ধর্মীয় দর্শনের গভীরে প্রবেশ করব। বিশেষ করে, আধুনিক ইতিহাসতত্ত্বের আলোকে সাম্রাজ্যের পতনের কারণ এবং অশোকের ‘ধম্ম’ নীতির স্বরূপ উদ্ঘাটন করা হবে।
১.১ ইতিহাসের উপাদান ও উৎস: সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা
মৌর্য ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য ঐতিহাসিকরা সাহিত্যের এবং প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের একটি জটিল সংমিশ্রণের ওপর নির্ভর করেন। এই উৎসগুলোর প্রত্যেকটির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা ইতিহাসের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে বিবেচ্য।
ক. সাহিত্যিক উৎস:
- অর্থশাস্ত্র: চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রণাদাতা কৌটিল্য (চাণক্য বা বিষ্ণুগুপ্ত) রচিত এই গ্রন্থটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি আকর গ্রন্থ। এটি কোনো ইতিহাস গ্রন্থ নয়, বরং এটি একটি ‘নর্মাটিভ’ (Normative) বা আদর্শলিপি, যা নির্দেশ করে একটি রাষ্ট্র কীভাবে চলা উচিত। ঐতিহাসিক ডি.ডি. কোসাম্বী এবং রোমিলা থাপারের মতো গবেষকরা মনে করেন, অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত অতি-কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা বাস্তবে কতটা প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে, তবে এটি মৌর্য আমলাতন্ত্র ও অর্থনীতির সবচেয়ে বিস্তারিত দলিল 3।
- ইন্ডিকা: গ্রিক রাষ্ট্রদূত মেগাস্থিনিস চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেছিলেন। তার মূল গ্রন্থটি হারিয়ে গেলেও, পরবর্তী গ্রিক ও রোমান লেখক—যেমন আরিয়ান, স্ট্রাবো, এবং ডিওডোরাস—এর উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন। মেগাস্থিনিসের বর্ণনায় পাটলিপুত্র নগরীর প্রশাসন এবং সামরিক ব্যবস্থার চমৎকার বিবরণ পাওয়া যায়। তবে, ভারতীয় ভাষা ও সমাজ সম্পর্কে তার অজ্ঞতার কারণে তিনি কিছু ভ্রান্ত তথ্যও দিয়েছেন, যেমন—ভারতে দাসপ্রথা নেই বা দুর্ভিক্ষের অস্তিত্ব নেই 6।
- বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য: সিংহলী ইতিবৃত্ত ‘মহাবংশ’ ও ‘দীপবংশ‘, এবং দিব্যাবদান, অশোকাবদান প্রভৃতি গ্রন্থে অশোকের ধর্মান্তর ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের বিবরণ রয়েছে। জৈন গ্রন্থ ‘পরিশিষ্টপার্বণ’ চন্দ্রগুপ্তের জৈন ধর্ম গ্রহণ ও শেষ জীবনের কথা বলে। তবে এই গ্রন্থগুলোতে অনেক ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সত্যের সাথে ধর্মীয় অতিরঞ্জন মিশে আছে 8।
- মুদ্রারাক্ষস: বিশাকদত্ত রচিত এই নাটকটি (আনুমানিক ৪র্থ-৫ম শতাব্দী খ্রিস্টাব্দ) অনেক পরে রচিত হলেও, এটি নন্দ বংশের পতন এবং চাণক্যের কূটকৌশলের এক নাটকীয় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ প্রদান করে 4।
খ. প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস:
- অশোকের শিলালিপি (Edicts): মৌর্য ইতিহাসের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস হলো অশোকের শিলালিপি। জেমস প্রিন্সেপ ১৮৩৭ সালে এগুলোর পাঠোদ্ধার করেন। এই লিপিগুলো প্রাকৃত ভাষায় ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপিতে এবং কান্দাহার অঞ্চলে গ্রিক ও আরামাইক ভাষায় লিখিত, যা সাম্রাজ্যের বহুভাষিক চরিত্রের প্রমাণ দেয়। এগুলো অশোকের নিজের কথা, যা সরাসরি প্রজার উদ্দেশ্যে খোদাই করা হয়েছিল 11।
- বস্তুগত নিদর্শন: উত্তর ভারতীয় কালো পালিশ করা মৃৎপাত্র (NBPW), পাটলিপুত্র ও তক্ষশিলার ধ্বংসাবশেষ, সাঁচি ও ভারহুতের স্তূপ, এবং প্রচুর সংখ্যক রৌপ্য ও তাম্র নির্মিত ‘আহত মুদ্রা’ (Punch-marked coins) মৌর্য অর্থনীতির সমৃদ্ধির সাক্ষ্য দেয় 1।
২. মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাস: উত্থান ও সম্প্রসারণ
মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থান কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে মগধকে কেন্দ্র করে যে সাম্রাজ্যিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা দানা বাঁধছিল, তার চূড়ান্ত পরিণতি। আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ উত্তর-পশ্চিম ভারতে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করেছিল এবং নন্দ রাজবংশের অত্যাচারী শাসন যে গণঅসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন।
২.১ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ – ২৯৭): সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বংশপরিচয় নিয়ে প্রাচীন সূত্রগুলোতে পরস্পরবিরোধী তথ্য পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণ্যবাদী সূত্রগুলো, যেমন পুরাণ ও মুদ্রারাক্ষস, তাকে নন্দ বংশের সাথে সম্পর্কিত এবং শূদ্র বা নিম্নবংশজাত বলে ইঙ্গিত করে। অন্যদিকে, বৌদ্ধ ও জৈন ঐতিহ্য তাকে নেপালের তরাই অঞ্চলের ‘মোরিয়’ নামক এক ক্ষত্রিয় গোত্রের সন্তান বলে দাবি করে। ‘মোরিয়’ শব্দটি ‘ময়ূর’ থেকে এসেছে, যা এই গোত্রের টোটেম বা প্রতীক ছিল। আধুনিক ঐতিহাসিকরা সাধারণত বৌদ্ধ ও জৈন মতটিকেই অধিক গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন 9।
নন্দ বংশের উচ্ছেদ ও মগধ বিজয়:
চন্দ্রগুপ্তের উত্থানের পেছনে তার গুরু ও মন্ত্রণাদাতা চাণক্যের ভূমিকা অনস্বীকার্য। চাণক্য নন্দ রাজা ধননন্দের রাজসভায় অপমানিত হয়ে নন্দ বংশ ধ্বংসের শপথ নিয়েছিলেন। তিনি তরুণ চন্দ্রগুপ্তকে তক্ষশিলায় নিয়ে যান এবং যুদ্ধবিদ্যা ও রাজনীতিতে পারদর্শী করে তোলেন। গ্রিক সূত্রগুলোতে চন্দ্রগুপ্তকে ‘স্যান্ড্রোকোটাস’ (Sandrocottus) বলা হয়েছে। জাস্টিন ও প্লুটার্কের বর্ণনা অনুযায়ী, চন্দ্রগুপ্ত আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর (৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) উত্তর-পশ্চিম ভারতে গ্রিক সত্রপ বা গভর্নরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং সেই অঞ্চল স্বাধীন করেন। এরপর তিনি তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে মগধের দিকে অগ্রসর হন 8।
বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘মিলিন্দপহ’-তে নন্দ ও মৌর্যদের যুদ্ধের ভয়াবহতার বর্ণনা আছে। প্রায় ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত ধননন্দকে পরাজিত করে মগধের সিংহাসন দখল করেন। এটি কেবল একটি রাজবংশের পরিবর্তন ছিল না, বরং একটি নতুন যুগের সূচনা ছিল।
সেলুকাসের সাথে সংঘাত ও আন্তর্জাতিক মৈত্রী:
চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিরিয়ার গ্রিক শাসক সেলুকাস নিকাটরের সাথে যুদ্ধ। আলেকজান্ডারের উত্তরাধিকারী হিসেবে সেলুকাস সিন্ধু নদের পূর্বাঞ্চল পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের বিশাল বাহিনীর কাছে তিনি পরাজিত হন। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়।
| সন্ধির শর্ত | বিবরণ ও ফলাফল |
| অঞ্চল হস্তান্তর | সেলুকাস চারটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ—আরিয়া (হিরাট), আরাকোশিয়া (কান্দাহার), জেড্রোসিয়া (বেলুচিস্তান) এবং প্যারোপানিজাদাই (কাবুল)—চন্দ্রগুপ্তকে ছেড়ে দেন। এর ফলে মৌর্য সাম্রাজ্যের সীমানা হিন্দুকুশ পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত হয় 1। |
| বৈবাহিক সম্পর্ক | দুই রাজবংশের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন, যা গ্রিক-মৌর্য সম্পর্ককে দৃঢ় করে 9। |
| যুদ্ধহস্তী উপহার | বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসকে ৫০০টি যুদ্ধহস্তী উপহার দেন। এই হাতিগুলো পরবর্তীতে ৩০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইপসাসের যুদ্ধে সেলুকাসকে বিজয়ী হতে সাহায্য করেছিল 15। |
| কূটনৈতিক বিনিময় | সেলুকাস মেগাস্থিনিসকে তার দূত হিসেবে পাটলিপুত্রে পাঠান। এটি ভারতের ইতিহাসে প্রথম নথিভুক্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক 9। |
চন্দ্রগুপ্ত জীবনের শেষভাগে জৈন ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সিংহাসন ত্যাগ করে ভদ্রবাহুর সাথে দক্ষিণ ভারতের শ্রাবণবেলগোলায় চলে যান। সেখানে তিনি জৈন প্রথা ‘সল্লেখানা’ (স্বেচ্ছায় অনশন) পালন করে মৃত্যুবরণ করেন 16।
২.২ বিন্দুসার (খ্রিস্টপূর্ব ২৯৭ – ২৭৩): অমিত্রঘাত
চন্দ্রগুপ্তের পর তার পুত্র বিন্দুসার সিংহাসনে বসেন। গ্রিক লেখকরা তাকে ‘অমিত্রোকেটিস’ (Amitrochates) বলে উল্লেখ করেছেন, যা সংস্কৃত ‘অমিত্রঘাত’ (শত্রু নিধনকারী) শব্দের গ্রিক রূপ। এটি প্রমাণ করে যে তিনি একজন শক্তিশালী যোদ্ধা ছিলেন। বিন্দুসার তার পিতার বিজিত সাম্রাজ্যকে অটুট রাখেন এবং সম্ভবত দাক্ষিণাত্যে আরও বিস্তার ঘটান। তিব্বতীয় ঐতিহাসিক তারনাথের মতে, বিন্দুসার ১৬টি রাজ্যের রাজাদের পরাজিত করে ‘দুই সমুদ্রের মধ্যবর্তী ভূমি’ (আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর) জয় করেছিলেন। কেবল কলিঙ্গ এবং সুদূর দক্ষিণের চোল, পাণ্ড্য, ও চের রাজ্যগুলো তার প্রত্যক্ষ শাসনের বাইরে ছিল 17।
বৈদেশিক ও ধর্মীয় নীতি:
বিন্দুসার সিরিয়ার রাজা প্রথম অ্যান্টিওকাসের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। অ্যান্টিওকাস তার রাজসভায় ডেইমাকাস (Deimachus) নামক দূত পাঠান। মিশরের রাজা ফিলাডেলফাস (দ্বিতীয় টলেমি) ডায়োনিসিয়াস নামক দূত প্রেরণ করেন। বিন্দুসার আজীবক সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার রাজসভায় পিঙ্গলবৎস নামক এক আজীবক ভবিষ্যৎবক্তার উপস্থিতির কথা জানা যায় 1।
২.৩ সম্রাট অশোক (খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮ – ২৩২): চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোক
বিন্দুসারের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার নিয়ে এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সিংহলী ইতিবৃত্ত মতে, অশোক তার ৯৯ জন ভাইকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। যদিও এটি অতিরঞ্জন হতে পারে, তবে শিলালিপি এবং সাহিত্যের প্রমাণ মিলিয়ে দেখা যায় যে, বিন্দুসারের মৃত্যু (২৭৩ খ্রি.পূ.) এবং অশোকের আনুষ্ঠানিক রাজ্যাভিষেকের (২৬৮ খ্রি.পূ.) মধ্যে চার বছরের ব্যবধান ছিল, যা গৃহযুদ্ধের দিকেই নির্দেশ করে 1।
কলিঙ্গ যুদ্ধ (২৬১ খ্রি.পূ.):
রাজ্যাভিষেকের অষ্টম বছরে অশোক কলিঙ্গ (বর্তমান ওড়িশা) আক্রমণ করেন। কলিঙ্গ ছিল কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি দক্ষিণ ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে স্থল ও জলপথে বাণিজ্যের চাবিকাঠি নিয়ন্ত্রণ করত। অশোকের ত্রয়োদশ শিলালিপিতে এই যুদ্ধের ভয়াবহ বিবরণ দেওয়া হয়েছে: ১,০০,০০০ মানুষ নিহত, ১,৫০,০০০ মানুষ বন্দী এবং লক্ষাধিক মানুষ যুদ্ধপরবর্তী দুর্ভিক্ষে মারা যায়। যুদ্ধের এই নারকীয় ধ্বংসলীলা অশোকের মনে গভীর অনুশোচনা জাগায় এবং তিনি চিরতরে দিগ্বিজয়ের পথ ত্যাগ করে ‘ধম্ম-বিজয়ে’র পথ বেছে নেন। তিনি ঘোষণা করেন, “ভেরীঘোষ (যুদ্ধের দামামা) আজ ধম্মঘোষে পরিণত হলো” 12।
৩. মৌর্য প্রশাসন: আমলাতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো
মৌর্য প্রশাসন ছিল প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম সুশৃঙ্খল, জটিল এবং কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা। কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ এবং মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে আমরা এই কাঠামোর বিস্তারিত জানতে পারি।
৩.১ সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব ও কেন্দ্রীয় শাসন
কৌটিল্য রাষ্ট্রকে সাতটি উপাদানের সমষ্টি হিসেবে দেখেছেন, যা ‘সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। এই সাতটি অঙ্গ হলো: ১) স্বামী (রাজা), ২) অমাত্য (মন্ত্রী ও আমলা), ৩) জনপদ (ভূখণ্ড ও জনগণ), ৪) দুর্গ (সুরক্ষিত রাজধানী), ৫) কোষ (রাজকোষ), ৬) দণ্ড (সেনাবাহিনী/আইন), এবং ৭) মিত্র (বন্ধু রাষ্ট্র)। মৌর্য শাসনে রাজা ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার উৎস, তবে তিনি ‘মন্ত্রীপরিষদ’-এর পরামর্শ নিতেন 5।
প্রধান কেন্দ্রীয় কর্মকর্তাগণ (অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী):
| পদবী | দায়িত্ব ও কর্তব্য |
| সমাহর্তা (Samaharta) | প্রধান রাজস্ব আদায়কারী এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত। বর্তমান অর্থমন্ত্রীর সমতুল্য 3। |
| সন্নিধাতা (Sannidhata) | রাজকোষ এবং গুদামঘরের প্রধান রক্ষক (Treasurer) 3। |
| সেনাপতি | সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। |
| অক্ষপটলাধ্যক্ষ | মহাহিসাবরক্ষক (Accountant General)। |
| সীতাধ্যক্ষ | কৃষি বিভাগের প্রধান, বিশেষত রাজকীয় জমির (Crown Lands) তত্ত্বাবধায়ক 3। |
| পণ্যাধ্যক্ষ | বাণিজ্য ও বাজার নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা। |
| লক্ষণধ্যক্ষ | টাঁকশাল ও মুদ্রা তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত 22। |
৩.২ প্রাদেশিক ও স্থানীয় প্রশাসন
সুবিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য এটিকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করা হয়েছিল। অশোকের শিলালিপি থেকে চারটি প্রধান প্রাদেশিক রাজধানীর নাম জানা যায়: তক্ষশিলা (উত্তরাপথ), উজ্জয়িনী (অবন্তীরথ), তোশালী (কলিঙ্গ) এবং সুবর্ণগিরি (দক্ষিণাপথ)। রাজপরিবারের সদস্য বা ‘কুমার’রা সাধারণত এই প্রদেশগুলোর শাসনকর্তা বা ভাইসরয় হিসেবে নিযুক্ত হতেন 23।
প্রদেশের নিচে ছিল ‘আহার’ বা জেলা, যা ‘রজ্জুক’ নামক কর্মকর্তাদের অধীনে ছিল। রজ্জুকরা জমি জরিপ এবং বিচারিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। প্রশাসনের সর্বনিম্ন স্তর ছিল গ্রাম, যেখানে ‘গ্রামিক’রা পঞ্চায়েতের মাধ্যমে স্থানীয় বিবাদ মেটাতেন 3।
৩.৩ বিচার ব্যবস্থা ও দণ্ডনীতি
মৌর্য বিচার ব্যবস্থা ছিল কঠোর। কৌটিল্য দুই ধরণের আদালতের উল্লেখ করেছেন:
১. ধর্মস্থীয় (Dharmasthiya): দেওয়ানি আদালত, যেখানে বিবাহ, উত্তরাধিকার এবং চুক্তি সংক্রান্ত বিবাদ নিষ্পত্তি হতো। এর বিচারকরা ধর্মশাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন।
২. কণ্টকশোধন (Kantakasodhana): ফৌজদারি আদালত, যা সমাজবিরোধীদের (কণ্টক) দমন করত। চোর, ডাকাত এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিচার এখানে হতো। এখানকার বিচারকদের বলা হতো ‘প্রদেষ্টা’ 16।
৩.৪ পাটলিপুত্রের নগর প্রশাসন (মেগাস্থিনিসের বিবরণ)
মেগাস্থিনিস পাটলিপুত্রের নগর প্রশাসনের যে বিবরণ দিয়েছেন, তা অত্যন্ত আধুনিক মনে হয়। ৩০ সদস্যের একটি নগর পরিষদ ৬টি কমিটিতে বিভক্ত হয়ে নগর পরিচালনা করত। প্রতিটি কমিটিতে ৫ জন সদস্য ছিল।
- ১ম কমিটি: শিল্প ও কারুশিল্পের তত্ত্বাবধান।
- ২য় কমিটি: বিদেশিদের আপ্যায়ন, চিকিৎসা এবং মৃত্যুর পর সৎকার।
- ৩য় কমিটি: জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন (আধুনিক আদমশুমারি ও ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস)।
- ৪র্থ কমিটি: ব্যবসা-বাণিজ্য ও ওজন পরিমাপ নিয়ন্ত্রণ।
- ৫ম কমিটি: উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয় তদারকি ও ভেজাল রোধ।
- ৬ষ্ঠ কমিটি: বিক্রয় কর আদায় (পণ্যের মূল্যের ১০%) 6।
৩.৫ গুপ্তচর বৃত্তি ও মণ্ডলে তত্ত্ব
মৌর্য সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের অন্যতম কারণ ছিল এর সর্বব্যাপী গুপ্তচর নেটওয়ার্ক। অর্থশাস্ত্রে এদের ‘গূঢ়পুরুষ’ বলা হয়েছে। এরা দুই প্রকারের ছিল: ‘সংস্থা’ (এক স্থানে অবস্থানকারী) এবং ‘সঞ্চারী’ (ভ্রমণকারী)। সন্ন্যাসী, ভিক্ষুক, এমনকি ‘বিষকন্যা’দেরও গুপ্তচর হিসেবে ব্যবহার করা হতো 3।
কৌটিল্যের ‘মণ্ডলে তত্ত্ব’ (Mandala Theory) ছিল বিদেশনীতির ভিত্তি। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, “শত্রুর শত্রু হলো বন্ধু”। একটি রাষ্ট্রের (বিজিগীষু) অবিলম্বে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হলো স্বাভাবিক শত্রু (অরি), এবং তার পরের রাষ্ট্রটি হলো বন্ধু (মিত্র)। এই চক্রাকার ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ আজও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক 21।
৪. অর্থনীতি: রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও সমৃদ্ধি
মৌর্য অর্থনীতি ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক, তবে রাষ্ট্র বাণিজ্য ও শিল্পের ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখত। রাষ্ট্রের নিজস্ব মালিকানাধীন জমিকে বলা হতো ‘সীতা’, এবং এর থেকে আয়ের ওপর ভিত্তি করেই বিশাল সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের ব্যয় নির্বাহ হতো।
কর ব্যবস্থা:
কৃষকদের উৎপাদনের ১/৬ বা ১/৪ অংশ কর বা ‘ভাগ’ হিসেবে দিতে হতো। এছাড়া সেচ সুবিধার জন্য ‘উদকভাগ’ নামক অতিরিক্ত কর দিতে হতো। জরুরি অবস্থায় ‘প্রণয়’ নামক অতিরিক্ত কর আরোপের বিধানও ছিল। কর ফাঁকি দেওয়াকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো 3।
মুদ্রা ও বাণিজ্য:
মৌর্য যুগে বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। তক্ষশিলা থেকে পাটলিপুত্র হয়ে তাম্রলিপ্তি বন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত ‘মহামর্গ’ বা ‘উত্তরাপথ’ (Grand Trunk Road-এর পূর্বসূরি) ছিল বাণিজ্যের ধমনী। রৌপ্য নির্মিত ‘পণ’ এবং তামার ‘মাষক’ ছিল প্রধান মুদ্রা। এই মুদ্রাগুলোকে ‘আহত মুদ্রা’ (Punch-marked coins) বলা হয়, কারণ এতে রাজকীয় প্রতীক (সূর্য, পাহাড়, গাছ) খোদাই করা থাকত। রাষ্ট্র খনি, লবণ, মদ এবং অস্ত্র তৈরির ওপর একচেটিয়া অধিকার বা মনোপলি বজায় রাখত 13।
৫. সমাজ ব্যবস্থা: মেগাস্থিনিস বনাম কৌটিল্য
মৌর্য সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে মেগাস্থিনিস এবং কৌটিল্যের বর্ণনায় উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা যায়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে চতুর্বর্ণ প্রথার (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) উল্লেখ থাকলেও মেগাস্থিনিস ভারতীয় সমাজকে পেশার ভিত্তিতে সাতটি জাতিতে বিভক্ত করেছেন:
১. দার্শনিক (ব্রাহ্মণ ও শ্রমণ)
২. কৃষক (সবচেয়ে বৃহৎ গোষ্ঠী)
৩. পশুপালক ও শিকারি
৪. কারিগর ও শিল্পী
৫. যোদ্ধা বা সৈনিক
৬. পরিদর্শক বা গুপ্তচর
৭. কাউন্সিলর বা মন্ত্রী 32।
মেগাস্থিনিস সম্ভবত ভারতের বর্ণ (Varna) এবং জাতি (Jati)-র পার্থক্য বুঝতে না পেরে পেশাভিত্তিক বিভাজনকেই জাতি মনে করেছিলেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে ভারতে দাসপ্রথা ছিল না। কিন্তু ভারতীয় উৎসগুলো (ত্রিপিটক ও অর্থশাস্ত্র) প্রমাণ করে যে দাসপ্রথা ছিল, তবে তা গ্রিক বা রোমান দাসপ্রথার মতো অমানবিক ছিল না। দাসদের সম্পত্তির অধিকার ছিল এবং তারা নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে মুক্তি পেতে পারত 7।
নারীদের অবস্থান ছিল মিশ্র। একদিকে যেমন ‘বিষকন্যা’ বা দেহরক্ষী হিসেবে নারীদের নিয়োগের প্রমাণ পাওয়া যায়, অন্যদিকে তাদের সম্পত্তির অধিকার এবং পুনর্বিবাহের সুযোগ (অর্থশাস্ত্র মতে) ছিল।
৬. অশোকের ধম্ম: ধর্ম নাকি রাজনৈতিক দর্শন?
অশোকের ‘ধম্ম’ (প্রাকৃত: ধম্ম, সংস্কৃত: ধর্ম) মৌর্য ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত এবং বিতর্কিত বিষয়। অনেক সাধারণ পাঠক ধম্মকে বৌদ্ধ ধর্মের সমার্থক মনে করেন, কিন্তু ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ তা পুরোপুরি সমর্থন করে না। অশোক নিজে ব্যক্তিগত জীবনে বৌদ্ধ ছিলেন, কিন্তু তার প্রচারিত ‘ধম্ম’ ছিল সর্বজনীন নৈতিকতার একটি সংকলন 35।
ধম্মের মূল বৈশিষ্ট্য:
অশোকের শিলালিপিগুলোতে (বিশেষ করে ২য় ও ৭ম স্তম্ভলিপি) ধম্মের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে—অল্প পাপ করা, অধিক পুণ্য করা, দয়া, দান, সত্যবাদিতা এবং পবিত্রতা। এর ব্যবহারিক দিকগুলো হলো:
- প্রাণী হত্যা ও হিংসা থেকে বিরত থাকা (অহিংসা)।
- পিতামাতা, গুরুজন ও শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা।
- দাস ও ভৃত্যদের প্রতি সদয় আচরণ।
- সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের (ব্রাহ্মণ ও শ্রমণ) প্রতি দান ও শ্রদ্ধা 36।
ঐতিহাসিক বিতর্ক:
- বৌদ্ধ ব্যাখ্যা: ডি.আর. ভান্ডারকর মনে করেন অশোকের ধম্ম হলো বৌদ্ধ ধর্মেরই গৃহী রূপ।
- রাজনৈতিক ব্যাখ্যা: রোমিলা থাপার যুক্তি দেখান যে, ধম্ম ছিল অশোকের নিজস্ব উদ্ভাবন এবং একটি সুচতুর রাজনৈতিক কৌশল। মৌর্য সাম্রাজ্য ছিল বহু ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির সমষ্টি। এই বৈচিত্র্যময় সাম্রাজ্যকে এক সুতায় বাঁধার জন্য অশোক এমন এক নৈতিক আদর্শ প্রচার করেন যা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের বিরোধী নয়, বরং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। এর মাধ্যমে তিনি সামাজিক উত্তেজনা হ্রাস এবং রাজার প্রতি আনুগত্য বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন 35।
ধম্ম প্রচার:
অশোক ‘ধম্ম মহামাত্র’ নামে বিশেষ কর্মকর্তা নিয়োগ করেন। তিনি শিলালিপি ও স্তম্ভলিপি স্থাপন করেন। তার ১৩তম শিলালিপিতে গ্রিক রাজাদের (অ্যান্টিওকাস, টলেমি, অ্যান্টিগোনাস, ম্যাগাস, আলেকজান্ডার) রাজ্যে ধম্ম-দূত পাঠানোর কথা উল্লেখ আছে, যা প্রমাণ করে তার ধম্ম প্রচার ছিল আন্তর্জাতিক 12।
৭. মৌর্য শিল্পকলা ও স্থাপত্য
মৌর্য যুগেই ভারতে প্রথম ব্যাপকভাবে পাথরের ব্যবহার শুরু হয়। মৌর্য শিল্পকলাকে দুটি ধারায় ভাগ করা যায়: রাজকীয় শিল্প (Court Art) এবং লোকশিল্প (Popular Art)।
স্তম্ভ ও পালিশ:
অশোকের একশিলা স্তম্ভগুলো (Monolithic Pillars) মৌর্য স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। চুনারের বেলেপাথরে নির্মিত এই স্তম্ভগুলোতে যে আয়না-সদৃশ পালিশ (Mauryan Polish) ব্যবহার করা হয়েছে, তা আজও বিস্ময়কর। সারনাথের সিংহশীর্ষ স্তম্ভটি (Lion Capital) এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ, যা চারটি সিংহ, ধর্মচক্র এবং হাতি, ঘোড়া, ষাঁড় ও সিংহের রিলিফ দ্বারা অলঙ্কৃত। এটি বর্তমানে ভারতের জাতীয় প্রতীক 38।
স্তূপ ও গুহা:
অশোক ৮৪,০০০ স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন বলে কথিত আছে। সাঁচি ও ভারহুতের স্তূপের মূল কাঠামো তার সময়েই তৈরি। এছাড়া বিহারের বারাবর পাহাড়ে আজীবক সন্ন্যাসীদের জন্য তিনি এবং তার পৌত্র দশরথ গুহা খনন করেন (লোমশ ঋষি গুহা)। এই গুহাগুলোর অভ্যন্তরীণ মসৃণতা মৌর্য কারিগরদের দক্ষতার সাক্ষ্য দেয় 38।
৮. মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন: কারণ ও বিশ্লেষণ
২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অশোকের মৃত্যুর মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে, ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এই পতনের কারণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
ক. ব্রাহ্মণদের প্রতিক্রিয়া (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী):
পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মনে করেন, অশোকের প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধকরণ এবং দণ্ডসমতা (সকলের জন্য সমান আইন) নীতি ব্রাহ্মণদের বিশেষ সুবিধা ক্ষুণ্ণ করেছিল। ফলে তারা মৌর্যদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিল। শেষ মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথকে তার ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যামিত্র শুঙ্গের হত্যা করাকে তিনি ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী বিপ্লব’ হিসেবে দেখেন। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকরা (যেমন হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী) এই মত সম্পূর্ণ গ্রহণ করেন না, কারণ শুঙ্গরাও বৌদ্ধ স্তূপ সংস্কার করেছিলেন 41।
খ. অহিংসা নীতি ও সামরিক দুর্বলতা:
অনেকে মনে করেন অশোকের অহিংসা নীতি মৌর্য সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে দিয়েছিল। কিন্তু রোমিলা থাপার দেখিয়েছেন যে, অশোক মৃত্যুদণ্ড রদ করেননি বা সেনাবাহিনী ভেঙে দেননি। তবে দীর্ঘকাল যুদ্ধ না থাকার ফলে সেনাবাহিনীর যুদ্ধের অভিজ্ঞতা কমে যেতে পারে 43।
গ. অর্থনৈতিক সংকট (ডি.ডি. কোসাম্বী):
ডি.ডি. কোসাম্বীর মতে, বিশাল আমলাতন্ত্র ও সেনাবাহিনী রক্ষণাবেক্ষণ এবং অশোকের বিপুল দান-ধ্যান রাজকোষকে শূন্য করে ফেলেছিল। পরবর্তী সময়ের মুদ্রায় খাদের পরিমাণ বৃদ্ধি (Debasement) এই অর্থনৈতিক সংকটের ইঙ্গিত দেয় 44।
ঘ. প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের অভাব (রোমিলা থাপার):
রোমিলা থাপার মনে করেন, মৌর্য প্রশাসন ছিল অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত এবং রাজার ব্যক্তিগত যোগ্যতার ওপর নির্ভরশীল। অশোকের পরবর্তী দুর্বল উত্তরাধিকারীরা (যেমন কুণাল, দশরথ) এই বিশাল যন্ত্র সচল রাখতে ব্যর্থ হন। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের দুর্নীতি এবং যোগাযোগের অভাবে দূরবর্তী অঞ্চলগুলো স্বাধীন হয়ে যায়। জাতীয় চেতনার অভাবও একটি কারণ ছিল 44।
ঙ. যবনিকা পতন:
১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এক সামরিক কুচকাওয়াজ চলাকালীন সেনাপতি পুষ্যামিত্র শুঙ্গ সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করেন এবং শুঙ্গ বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমেই ভারতের প্রথম মহান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে 46।
৯. উপসংহার
মৌর্য সাম্রাজ্য ভারতীয় ইতিহাসের গতিপথ চিরতরে বদলে দিয়েছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং চাণক্য যে রাজনৈতিক ঐক্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন, অশোক তাকে এক মানবিক ও নৈতিক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও সাম্রাজ্যটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, কিন্তু এর প্রশাসনিক কাঠামো, কর ব্যবস্থা এবং আমলাতন্ত্র পরবর্তী গুপ্ত ও মুঘল, এমনকি ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করেছিল। অশোকের ‘ধম্ম’—যা পরমতসহিষ্ণুতা এবং অহিংসার কথা বলে—তা আজকের সংঘাতপূর্ণ পৃথিবীতেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। শিল্পকলা, স্থাপত্য এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মৌর্যদের অবদান ভারতকে বিশ্বমঞ্চে এক মর্যাদাপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল।
Works cited
- Maurya Empire – Wikipedia, accessed on December 6, 2025, https://en.wikipedia.org/wiki/Maurya_Empire
- Mauryan empire | Definition, Map, Achievements, & Facts | Britannica, accessed on December 6, 2025, https://www.britannica.com/place/Mauryan-Empire
- Administration During Mauryan Period – Ancient India History Notes, accessed on December 6, 2025, https://prepp.in/news/e-492-administration-during-mauryan-period-ancient-india-history-notes
- Historicising the Arthaśāstra: Early Fiscal-Military States in South Asia, accessed on December 6, 2025, https://www.orfonline.org/research/historicising-the-artha-stra-early-fiscal-military-states-in-south-asia
- KAUTILYA:- SAPTANGA THEORY OF STATE – Shivaji College, accessed on December 6, 2025, https://www.shivajicollege.ac.in/sPanel/uploads/econtent/66c1b1900859b291df69f17ffced09ae.pdf
- With reference to the city administration of Mauryan Empire, consider the following statements:(i) Megasthenes put light on the Mauryan city administration. (ii) The city council was divided into six committees. (iii) City administration was well planned. Which of the above statements is/are correct? – Adda247, accessed on December 6, 2025, https://www.adda247.com/question-answer/with-reference-to-the-city-administration-of-mauryan-empire-consider-the-following-statements-i-megasthenes-put-light-on-the-mauryan-city-administ/q.v1.9995c908-b8c4-4200-97b8-9386eb57cb5a-en
- Indica (Megasthenes) – Wikipedia, accessed on December 6, 2025, https://en.wikipedia.org/wiki/Indica_(Megasthenes)
- Rise of the Maurya Empire | World Civilization – Lumen Learning, accessed on December 6, 2025, https://courses.lumenlearning.com/suny-hccc-worldcivilization/chapter/rise-of-the-maurya-empire/
- Mauryan Empire, Origin, Rulers, Map, Economy, Decline, UPSC Notes – Vajiram & Ravi, accessed on December 6, 2025, https://vajiramandravi.com/upsc-exam/mauryan-empire/
- Chandragupta Maurya – Wikipedia, accessed on December 6, 2025, https://en.wikipedia.org/wiki/Chandragupta_Maurya
- Edicts of Ashoka – Wikipedia, accessed on December 6, 2025, https://en.wikipedia.org/wiki/Edicts_of_Ashoka
- The Edicts of King Asoka – Access to Insight, accessed on December 6, 2025, https://www.accesstoinsight.org/lib/authors/dhammika/wheel386.html
- Mauryan Empire – Universal Group Of Institutions Bangalore, Karnataka, accessed on December 6, 2025, https://universalinstitutions.com/mauryan-empire/
- Chanakya and Chandragupta Maurya: Defeat of the Nanda Empire – bharatdocs, accessed on December 6, 2025, https://bharatdocs.com/chanakya-and-chandragupta-maurya-fall-of-the-nanda-empire/
- Expansion of the Maurya Empire | World Civilization – Lumen Learning, accessed on December 6, 2025, https://courses.lumenlearning.com/suny-hccc-worldcivilization/chapter/expansion-of-the-maurya-empire/
- A type of court called ‘Kantakasodhana’ was prevalent in the ______ Empire. – Testbook, accessed on December 6, 2025, https://testbook.com/question-answer/a-type-of-court-called-kantakasodhana-wa–61c5987e9f934c3b46c41b71
- List of the Mauryan Empire Kings: A Brief Overview of Their Administrative Roles & Victory, accessed on December 6, 2025, https://www.jagranjosh.com/general-knowledge/list-of-the-mauryan-empire-kings-a-brief-overview-of-their-administrative-roles-and-victory-1739975974-1
- Political history of the mauryas chandragupta Maurya – BrainKart, accessed on December 6, 2025, https://www.brainkart.com/article/Political-history-of-the-mauryas-chandragupta-Maurya_1223/
- Ashoka: Kalinga War, Dhamma, Rock Edicts & Inscriptions – NEXT IAS, accessed on December 6, 2025, https://www.nextias.com/blog/ashoka/
- Ashoka’s Conversion | World Civilization – Lumen Learning, accessed on December 6, 2025, https://courses.lumenlearning.com/suny-hccc-worldcivilization/chapter/ashokas-conversion/
- The Mandala Theory: A brief overview – Young Indian Revolution Journals Pvt. Ltd., accessed on December 6, 2025, https://youngindianrevolution.com/2020/07/28/the-mandala-theory-a-brief-overview/
- Mauryan Empire: Administration, Economic Condition and Art – History Discussion, accessed on December 6, 2025, https://www.historydiscussion.net/empires/mauryan-empire-administration-economic-condition-and-art-during-the-mauryan-period/616
- Mauryan Administration: Army, Occupation, Taxation, Trade and Society – Studynlearn, accessed on December 6, 2025, https://studynlearn.com/mauryan-administration
- Mauryan Administration: Central, Provincial, Judicial Systems – PWOnlyIAS, accessed on December 6, 2025, https://pwonlyias.com/udaan/mauryan-administration/
- UPSC Notes on Mauryan Administration – Unacademy, accessed on December 6, 2025, https://unacademy.com/content/upsc/study-material/ancient-history/mauryan-administration/
- With reference to ancient India the terms 39 Dharmasthiya 39 and 39 kantakasodhana 39 are related to……….. – Abhipedia, accessed on December 6, 2025, https://abhipedia.abhimanu.com/Article/4/NDYyOTQ3/With-reference-to-ancient-India-the-terms-39-Dharmasthiya-39-and-39-kantakasodhana-Mauryan-and-Post-Maurayan-
- Foreign accounts: Part III: Megasthenes’ Account – self study history, accessed on December 6, 2025, https://selfstudyhistory.com/2020/05/01/foreign-accounts-megasthenes-account/
- The city administration of Pataliputra was conducted by six committees, which of the following is/are committee/s? 1. Industry 2. Tax collection 3. Agriculture Choose the correct answer from below given codes – ForumIAS Blog, accessed on December 6, 2025, https://forumias.com/blog/question/the-city-administration-of-pataliputra-was-conducted-by-six-committees-which-of-the-following-is-are-committee-s-1-industry-2-tax-collection-3-agriculture-choose-the-correct-answer-from-below-giv/
- Kautilya’s Mandala Theory – Research Journal of Humanities and Social Sciences, accessed on December 6, 2025, https://rjhssonline.com/HTMLPaper.aspx?Journal=Research%20Journal%20of%20Humanities%20and%20Social%20Sciences;PID=2012-3-1-32
- KAUTILYA’S MANDALA THEORY AND ITS RELEVANCE – Brillopedia, accessed on December 6, 2025, https://www.brillopedia.net/post/kautilya-s-mandala-theory-and-its-relevance
- The Maurya and Gupta Empires (article) – Khan Academy, accessed on December 6, 2025, https://www.khanacademy.org/humanities/world-history/ancient-medieval/early-indian-empires/a/the-maurya-and-gupta-empires
- [Solved] Who classified Indian society into seven classes? – Testbook, accessed on December 6, 2025, https://testbook.com/question-answer/who-classified-indian-society-into-seven-classes–65301cb7f0ef79e14814fd10
- A unique thing about the varna system mentioned in the Indica – True IndoloGy’s Space, accessed on December 6, 2025, https://spaceoftrueindology.quora.com/A-unique-thing-about-the-varna-system-mentioned-in-the-Indica
- Mauryan Society: A Case Study of Megasthenes Manjeet Singh, Punjab, India – Social Research Foundation, accessed on December 6, 2025, http://www.socialresearchfoundation.com/upoadreserchpapers/1/309/1910240811111st%20manjeet%20singh.pdf
- Ashoka’s policy of Dhamma – Wikipedia, accessed on December 6, 2025, https://en.wikipedia.org/wiki/Ashoka%27s_policy_of_Dhamma
- Ashoka Inscription- Rock Edicts – BYJU’S, accessed on December 6, 2025, https://byjus.com/free-ias-prep/ncert-notes-ashokas-edicts/
- Spread of Buddhism at the time of King – INHCRF, accessed on December 6, 2025, https://inhcrf.org/blogs/spread-of-buddhism-at-the-time-of-king-asoka-3rd-century-bce-to-1st-century-bce/
- Mauryan Art and Architecture: About, Features and More – NEXT IAS, accessed on December 6, 2025, https://www.nextias.com/blog/mauryan-art-and-architecture/
- Pillars of Ashoka – Wikipedia, accessed on December 6, 2025, https://en.wikipedia.org/wiki/Pillars_of_Ashoka
- Mauryan Art and Architecture – PMF IAS, accessed on December 6, 2025, https://www.pmfias.com/mauryan-art-and-architecture/
- Pushyamitra Sunga’s Revolt: Brahmanical Debate | PDF – Scribd, accessed on December 6, 2025, https://www.scribd.com/document/838463605/Mauryas
- Ashoka And Pushyamitra Sunga: A Study In Mythmaking – IndiaFacts.org, accessed on December 6, 2025, https://indiafacts.org/ashoka-and-pushyamitra-sunga-a-study-in-mythmaking/
- Causes of the downfalls of the Mauryan Empire – online note bank, accessed on December 6, 2025, https://onlinenotebank.wordpress.com/2024/07/31/causes-of-the-downfalls-of-the-mauryan-empire/
- A Study of the Disintegration of the Maurya Empire – RAIJMR, accessed on December 6, 2025, https://www.raijmr.com/ijrhs/wp-content/uploads/2023/04/IJRHS_2023_vol11_issue_02_02.pdf
- Asoka And The Decline Of The Mauryas, accessed on December 6, 2025, https://ia800402.us.archive.org/35/items/in.ernet.dli.2015.126947/2015.126947.Asoka-And-The-Decline-Of-The-Mauryas_text.pdf
- Decline of Maurya Empire: History, Causes, Legacy & UGC NET History Notes – Testbook, accessed on December 6, 2025, https://testbook.com/ugc-net-history/decline-of-mauryan-empire
- Decline of the Maurya Empire | Early World Civilizations – Lumen Learning, accessed on December 6, 2025, https://courses.lumenlearning.com/atd-herkimer-worldcivilization/chapter/decline-of-the-maurya-empire/





